Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি

নতুন করে বাঁধ ভেঙে আরো হাওর প্লাবিত

| প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০৪ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : বৃহত্তর সিলেটসহ কিশোরগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে কৃষকের একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। ক্ষতিগ্রস্তরা সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য নিমজ্জিত এলাকাকে দুর্গত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা
ঘোষণার দাবি
আজিজুল ইসলাম চৌধুরী : সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার প্রায় সব কয়েকটি হাওরের বোরো ফসল এখন পানির নিচে। ফসল হারিয়ে জেলার তিন লক্ষাধিক কৃষক পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাই সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিও জোরালো হচ্ছে। পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকসহ জেলার সচেতন মহল পানি উন্নয়ন বোর্ড, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেনটেশন কমিটির) বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছেন। জেলা সদরসহ সব উপজেলায় দুর্নীতিবাজ পাউবোর কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসির বিরুদ্ধে মানবন্ধন এবং বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাতে ও হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে এ পর্যন্ত জেলার দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির মধ্যে ৮০ ভাগ ফসল তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এখনো ফসলের ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম বলছেন। এ বিভাগের কর্মকর্তা স্বপন কুমার সাহা ইনকিলাবকে বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেল পর্যন্ত জেলার ৯৭ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার পরিমাণ এক হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এ দিকে এ জেলার বোর ফসল তলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অসাধু ব্যবসায়ীরা চাল, আটাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম রাতরাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ৫০ কেজি চালের বস্তা দুই হাজার টাকার স্থলে ২৫ থেকে ২৬’শ টাকায় বিক্রি করছেন। আটার দাম বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার জন্য কৃষিক, শ্রমিক জনতা মাঠে নেমেছেন। স্থানে স্থানে তারা বিক্ষোভ করছেন। পাশাপাশি যাদের খামখেয়ালিপনার কারণে কৃষকদের এত বড় বিপর্যয় ঘটেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠেছে। সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ স্থানীয় ট্রাফিক পয়েন্টে এক সমাবেশে সুনাগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ১০ টাকা কেজি ধরে চাল বিক্রিসহ এর আওতা দ্বিগুন এবং কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের দাবি জানান তিনি।
কমলগঞ্জে আকস্মিক বন্যা
এম এ ওয়াহিদ রুলু : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে গত দু’দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরনো দু’টি ভাঙনের পাশাপাশি রাত সাড়ে ৮টায় নতুন করে আরো দু’টি স্থানে ভাঙনের ফলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে ২০টি গ্রামের ৩০ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়ক দুই ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। কমলগঞ্জ সদর হাসপাতালে পানি প্রবেশ করেছে। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুল হক বুধবার রাত ১০টায় বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
জানা যায়, কমলগঞ্জ পৌরসভার গোপালনগর এলাকার মনবাবুর বাড়ি সামনে একটি ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের কোনাগাঁও এলাকায় নদী ভাঙনের ফলে পৌরসভার গোপালনগর, নাগড়া, করিমপুর, যোদ্ধাপুর এলাকা ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের কোনাগাঁও, ঠাকুর বাজার, মইডাইল, সোনাপুর, ঘোষপুর ও শংকরপুরসহ ২০টি গ্রামের ৩০ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ধলাই নদীর প্রায় ১৫টি স্থান সম্পূর্র্ণ ঝুঁঁকিপূর্র্ণ থাকায় আরো ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভানুগাছ বাজারের পাশে নতুন ব্রিজ এলাকায় ঝ‚ঁকিপূর্ণ ফাটল থাকায় কমলগঞ্জ পৌর এলাকার ভানুগাছ বাজার হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে কমলগঞ্জ পৌর এলাকার ভানুগাছ চৌমুহনা সংলগ্ন কুমড়াকাপন এলাকায় জলাবদ্ধতায় লোক চলাচল মারাত্মভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দিরাইয়ে নতুন করে হাওর প্লাবিত
মুহাম্মদ আবদুল বাছির সরদার : দিরাইয়ে নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গতকালও নতুন করে হাওর প্লাবিত হয়েছে। ফলে এ পর্যন্ত দিরাইয়ে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্তের হারও বেড়েছে। দিরাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভার ভরাম হাওর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এ হাওরে মোট তিন হাজার ২০০ হেক্টর ধানের আবাদ হয়েছিল। এ ছাড়া এ পর্যন্ত দিরাই উপজেলায় মোট আক্রান্ত জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর। এ বছর দিরাই উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নে আবাদ করা হয়েছিল মোট ২৮ হাজার হেক্টর। বাকি বোরো জমিগুলোও প্রচÐ ঝুঁকিতে আছে বলে জানায় উপজেলা কৃষি অফিস।
এদিকে গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদীতে পানি পূর্ণ হয়ে একের পর এক হাওরে প্রবেশ করছে। গতকালও সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দু’টি হাওরে পানি প্রবেশ করে।
কিশোরগঞ্জে বেড়িবাঁধ ভাঙন অব্যাহত
এ কে নাসিম খান : ভারি বর্ষন ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওর অঞ্চলে নতুন নতুন হাওর প্লাবিত হচ্ছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইটনা উপজেলার নন্দার বাঁধ, সিঙ্গার বাঁধ, বুর্শিকুড়া বাঁধ, জল্লার বাঁধ, অষ্টগ্রাম উপজেলার বিলমাঙ্গা বাঁধ, মিঠামইন উপজেলার কাটখাল বাঁধ ভেঙে হাজার হাজার একর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে হাওর অঞ্চলের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার ৩৫টি বাঁধ ভেঙে ৩০ হাজার হেক্টর বোরো জমির ফসল তলিয়ে গেছে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে এখনো পানি বাড়ছে এবং নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে হাওর অঞ্চলের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৪৬ হেক্টর জমিতে বোরো ফসল আবাদ করা হয়েছিল। গত এক সপ্তাহের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২৩ হাজার ২১৪ হেক্টর বোরো জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও ভারি বর্ষণের কারণে জেলার নিকলী, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও ভৈরব উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। এলাকার কৃষকরা এ বছর বোরো ধান ঘরে তুলতে না পেরে পড়েছেন হতাশায়। তার পরও অনেক কৃষক পানির নিচে তলিয়ে থাকা কাঁচা ধান ঘরে তুলছেন।
নিকলীতে ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার বেশি
মু হেলাল উদ্দিন : কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল বলে খ্যাত নিকলী উপজেলা, এখানকার মানুষের প্রধান অর্থকরি ফসল বোরো ধান। বছরে তাদের একটি মাত্র ফসল বোরো আবাদ। কৃষকের ঘাম ঝরানো সে ফসলের মাঠ এখন পানির নিচে। ভারী বর্ষণ ও উওর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিকলীর ডুবি, খাসিপুর, গোরাদিঘা, বরাটিয়া, হংরাইল, সিংপুর, এলাকার হাওরগুলোর নদীর চর, বিলের পাড়, হাইল ক্ষেত (নিচু) জমির ২৮ ব্রি ও ২৯ ব্রি জাতের ধান পানির নিচে। অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার প্রায় ১২৫ হেক্টর জমি পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সব জমিতে প্রায় ৬২৫ মেট্টিক টন ধান উৎপাদন হতো। যার বাজার মূল্যে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক কোটি ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ও হুমকির মুখে রয়েছে ডুবি মৌজার খয়ের কান্দার হাওর রক্ষা বাঁধ এবং সিংপুর হাওরের বড় বাঁধ । যদি এ দু’টি বাঁধ ভেঙে যায়, তবে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হবে। আর চরমভাবে দুর্ভোগের মুখোমুখি হবে এলাকার কৃষক পরিবারগুলো।
নেত্রকোনায় বেড়েই চলছে ক্ষতির পরিমাণ
এ কে এম আব্দুল্লাহ : গত এক সপ্তাহের অব্যাহত বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে একের পর এক হাওড়ে পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ হাওড়াঞ্চলের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়তই কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। কয়েকদিন আগেও যেখানে সোনালী ধানের শীষ বাসাতে দোলা খাচ্ছিল সেখানে এখন ঢলের ঘোলা পানি চারদিকে থই থই করছে ।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের তোড়ে গতকাল পর্যন্ত মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন, বারহাট্টা, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলার বিভিন্ন হাওড়ে উজানের ঢলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও উদাসীনতা এবং আগাম বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারদের ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে সময়মত কাজ সঠিকভাবে না করায় এর মাশুল দিতে হচ্ছে কৃষকদেরকে। সরকার প্রতি বছর বাঁধ মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের লুটপাটের কারণে কাজ সঠিকভাবে না হওয়ায় অকাল বন্যায় বাঁধ ভাঙে আর পানিতে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল বলেন, এ বছর জেলায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৩শ’ ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। এর মধ্যে শুধু হাওড় অঞ্চলেই আবাদ হয়েছিল ৪০ হাজার ৬শ’ ২০ হেক্টর। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৮ হাজার ১শ’ ১৫ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্গত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ