Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্গত মানুষের কান্না

প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোথাও যেন এতটুকু শান্তির জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে বলা যায়, আমরা ভালো আছি। একটা সময় চীনের দুঃখ হিসেবে হোয়াং হো নদীর কথা শোনা যেত। এখন আর তেমনটা শোনা যায় না। কারণ, চীন তার নদীর দুই ধারে বাঁধ দিয়ে সেই দুঃখ ঘুচিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশের চিত্র ঠিক তার উল্টো। বন্যা আসে বন্যা যায়, তবু বন্যা প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেয়া হয় না। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকা তলিয়ে যায়। তার প্রতিকার যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে করা হয় না। প্রতি বছরই লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। দুর্গত এলাকার হাজারো মানুষ এক বেলা খাবার কিংবা মাথা গোঁজার ঠাঁই পায়নি। শিশুসহ বেশ কিছু মানুষের প্রাণ চলে গেছে না ফেরার দেশে। বন্যার পানিতে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগ তেমন চোখে পড়েনি।
বন্যা দুর্গত মানুষেরা ত্রাণের নৌকার আশায় পথ চেয়ে বসে থেকেছে। শিশুরা নৌকা দেখামাত্রই দৌড়ে ছুটে গেছে কিছু খাবারের আশায়। পত্রিকার পাতায় যখন ওইসব শিশুর ছবি দেখেছি তখন দ্রুত পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে ফেলেছি। কারণ যে সময়ে ওইসব শিশু অনাহারে, রোদ্রে পুড়ে অভুক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, সে সময়ে আমরা আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছি। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো যে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাও আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। অসহায়, সম্বলহীন ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার আর চিৎকারে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। তবু তাদের পাশে সহানুভূতির হাত প্রসারিত করার মানুষ তেমন খুঁজে পাওয়া যায় নি।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এবার দেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। এসব এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভয়াল বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে রোগাক্রান্ত হয় ৩ হাজার ২২ জন, মারা যায় ৪৫ জন। বন্যার্তদের সহায়তায় যে সহায়তা সরকার দিয়েছে তা অপ্রতুল। ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) তথ্যমতে, দেশের ১৯টি জেলার ৫৯টি উপজেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ১৫ হাজার আংশিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ১ হাজার ৩৪৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮০ কিমি. পাকা রাস্তা এবং ২ হাজার ৫৩৮ কিমি. কাঁচা রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। ১৫৮ আশ্রয় কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বন্যায় ১৭ জেলার ৯৪ হাজার ৫৩৬ হেক্টর আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে।
প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয় তার সিংহভাগ ক্ষতি হয় বন্যায়। উত্তরোত্তর এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এর প্রধান কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, আমাদের নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের একচোখা নীতি। ভারত থেকে আসা অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি। বর্ষাকালে এসব নদীর মোট পানিপ্রবাহের সিংহভাগ আসে ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে। উজানে ভারি বর্ষণ হলে সেই পানি নেমে আসে বাংলাদেশে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারত গজলডোবা ব্যারেজের গেট খুলে দিলে তিস্তা পাড়ের মানুষের বন্যার পানিতে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী বড় একটি রাষ্ট্র, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতের জনগণের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। তারপরেও ভারত তার প্রয়োজনে আমাদের বন্ধু বানায় আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। তিস্তাপাড়ের মানুষ বন্যার জন্য ভারত নিয়ন্ত্রিত গজলডোবা ব্যারেজকে দায়ী করে। নিকট অতীতেও তিস্তা নদীর পানি চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সরকারের মধ্যে বার বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের জনগণের কোনো লাভ হয়নি।
মানুষ মানুষের জন্য সহানুভূতির হাত প্রসারিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ সহানুভূতির পরিবর্তে দুর্যোগ কবলিত মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতে ওঠে। সমাজের বিবেকবান মানুষকে অনুরোধ করে বলব, যে কোনো দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের জ্বালা বা যন্ত্রণা ক্ষুধার্তরাই অনুধাবন করতে পারে। এসি বাড়ি আর এসি গাড়িতে চড়ে ওদের কষ্ট বোঝা যায় না। হয়তো এ কারণেই সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অভুক্ত মানুষের পাশে দেখা যায় না। কারণ তারা বুঝতেই পারে না পেটে খাবার না থাকলে কেমন লাগে। ধনাঢ্য পরিবারের একটি বিদেশী কুকুরের জন্য যে পরিমাণ নাস্তা বরাদ্দ থাকে সে পরিমাণ টাকা দিয়ে কয়েকজন ক্ষুধার্ত মানুষের একদিনের খাবার হয়ে যায়। সমাজের বিবেকবান মানুষ যদি এক দিনের বিনোদনের খরচ বাঁচিয়ে দুর্গতদের দিয়ে দিত তাহলে বিপন্ন মানুষ একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারত। আমাদের প্রত্যাশা, রাষ্ট্র দুর্গত মানুষের সেবা ও কল্যাণে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করবে। পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসন করার কাজটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করবে। এ দায়িত্ব রাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্গত মানুষের কান্না
আরও পড়ুন