Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খোঁড়াখুঁড়িতে ভোগান্তি

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

* সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোর খননে ছিন্ন ভিন্ন রাজধানীর রাজপথ থেকে গলিপথ
* নগরীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণের অনেক রাস্তাই চলাচলের অনুপযুক্ত
*  তদারকি যথাযথভাবে না হবার অভিযোগ
*  ধুলা-কাদায় / শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী
সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব। নগরীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এর মধ্যে দুয়েকটি সড়ক দিয়ে কোনো রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তাই এখন চলাচলের অনুপযুক্ত। সিটি কর্পোরেশন, মেট্টোরেল স্থাপনের কাজের জন্য, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খনন করছে রাস্তা।
এ সমস্ত খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নেই কোনো সঠিক তদারকি। ঠিকাদারেরা যে যেমন খেয়ালখুশিমত কাজ করছে। একটু বৃষ্টিতেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকে না। রাস্তার মাঝখানে যখন-তখন বিকল হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। অফিস আদালতমুখী মানুষ ও স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সকাল বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছে চরম ভোগান্তিতে। কোথাও অসহনীয় যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে আবার কোথাও যানবাহনেরে সঙ্কটে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্ট। ইচ্ছা থাকলেও ময়লা, কাদা-পানি ও পিচ্ছিল রাস্তায় পায়ে হাঁটাও সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে আবার রোদ উঠলে বাতাসে ধুলা-বালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে ধুলা-বালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. আহম্মাদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, বাতাসের সাথে মিশে থাকা ধুলাবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। এতে করে মানুষ কাশি, য²া, শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যে কারণে মানুষের ফুসফুস অস্তে আস্তে কর্মক্ষম হয়ে পড়ে। যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীর উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাকে রাস্তা কাটার সীমিত পরিসরে অনুমোদন দেয়ার কথা থাকলেও এ জন্য রয়েছে কঠোর নিয়ম-নীতি। এ নিয়ম-নীতি তদারকি করার মূল দায়িত্বে রয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার চলমান উন্নয়ন কাজ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উন্নয়ন কাজের নেই কোনো সুনির্দিষ্ট তদারকি। যে কারণে নগরবাসী পড়েছে চরম দুর্ভোগে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়াও ভাঙাচুরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। যে কারণে রাজধানীর প্রায় সবগুলো রাস্তাই এখন খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ৩১ মে’র মধ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে থাকলেও এ বছর তা সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে। কারণ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত বছর যে কাজ শুরু করেছিলেন সে কাজও এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি। তার উপর এ বছরও তারা আরও প্রায় ৪/৫ শতাধিক সড়ক মেরামতের কাজ একসাথে ধরেছে। দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এ সব কাজ শেষ হতে আরও অন্তত ৫/৬ মাস সময় লেগে যেতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, নগরবাসীর নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষেইতো সিটি কর্পোরেশনকে উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়। এ ধরনের কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যাতো হতেই পারে। এ জন্য নগরবাসীকেও কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। উন্নয়ন কাজ চলা সময়ের ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মেয়র নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি শুকনো মৌসুমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন সংস্থাকে ৮৮টি স্থানে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের পথে থাকা বিদ্যুতের লাইন অপসারণের কাজও রয়েছে।
খোঁড়াখুঁড়ির পূর্বশর্ত হলো প্রতিদিনের খনন করা অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকা, আড়াআড়ি খননের ক্ষেত্রে স্টিলের পাত দিয়ে গর্ত ঢেকে রাখা, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে খননের উদ্দেশ্য, কাজ শুরু ও সমাপ্তির তারিখ প্রদর্শন করতে হবে। অনিবার্য না হলে খনন কাজ শুধু রাতেই করতে হবে এবং সকাল হওয়ার আগে খনন করা মাটি বা পরিত্যক্ত নির্মাণ সামগ্রী (রাবিশ) সরিয়ে নিতে হবে।
রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, গুলশান, রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরে কোথাও এসব শর্ত পালন করার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এমনকি সিটি কর্পোরেশন নিজে যেসব স্থানে নির্মাণ কাজ চালাচ্ছে, সেসব স্থানেও শর্ত পূরণ হচ্ছে না। ফলে অন্তত তিন মাস ধরে রাজধানীর মানুষ যানজট আর ধুলার রাজ্যে বসবাস করছে। গত সপ্তাহে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির কারণে কিছু স্থানে সড়কে পানি জমে আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলো যতদ্রæত সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করছি। নিয়ম অনুযায়ী কাজ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নির্দেশনা দেয়া আছে। যাতে নাগরিক দুর্ভোগ এড়ানো যায় সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক করা আছে। তিনি বলেন, অন্যদিকে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে শর্তমত কাজ করে না। এতেই সমস্যা হয়। তিনি বলেন, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি যাতে নগরবাসীর ভোগান্তি কিছুটা কমানো যায়।
দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, অনুমতি পাওয়া সংস্থা বা ঠিকাদারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খনন করা অংশ ভরাট করার কথা। এরপর সড়ক পিচ ঢালাই করে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেন, সিটি কর্পোরেশন বাদে যারা সড়ক খুঁড়ছে, তারাও সরকারি সংস্থা। প্রত্যেক সংস্থার নিজস্ব দায়িত্ব আছে। যাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছে না। আর উত্তর সিটির অধীন কাজের ঠিকাদাররা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিয়ম মেনে কাজ করছেন। খুঁড়ে তোলা মাটি সব সময় দিনেরটা দিনে সরানো সম্ভব হয় না।
মগবাজার উড়াল সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে, তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শর্ত ছিল নির্মাণ কাজ চলার সময় জনগণের ব্যবহারের সড়কটি উপযোগী রাখা হবে। কিন্তু প্রকল্প এলাকার প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে বর্তমানে পানি-কাদায় মাখামাখি অবস্থা বিরাজ করছে। বৃষ্টির পরই খানাখন্দে ভরা সড়কের এই অবস্থা হয়েছে। এর আগে পুরো শুকনো মৌসুম কেটেছে ধুলার রাজ্যে।
এই প্রকল্প এলাকার আশপাশে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আবুজর গিফারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মৌচাক, আনারকলি, আয়েশা শপিং মল, ফরচুন শপিং মল, হোসাফ টাওয়ারসহ অসংখ্য বিপণি বিতানের অবস্থান ওই এলাকায়।
শান্তিনগরের বাসিন্দা খাইরুন নেসা বলেন, এই এলাকাটি বর্তমানে শুধু চলাচলের অনুপযোগীই নয় বিপজ্জনকও। দুর্ভোগের চেয়ে কখন রিকশা উল্টে দুর্ঘটনার শিকার হই এটা নিয়েই চিন্তায় থাকি। মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন ভিকারুননিসা নূন স্কুলে আসা-যাওয়া করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাকে বলে জানান।
মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় গত ২ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিন কিলোমিটার সড়কের দুপাশে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) রাস্তা খননের কাজ শুরু করে। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের শেওড়াপাড়া থেকে কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশেই গর্ত খোঁড়া। নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। কোথাও কোথাও একটা করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের এপার-ওপার হওয়ার জন্য বাঁশ-স্টিলের পাত ফেলা হয়েছে। গর্তের মাটি সড়কেই পড়ে আছে। যানবাহনের চাকার সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ধুলা হয়ে চারদিকে উড়ছে। আশপাশের ভবন-দোকানগুলো ধুলার রঙে ধূসর।
মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আমিনুর রহমান বলেন, সড়ক খোঁড়া হয়েছে ৫ ফুট কিন্তু যন্ত্রপাতি, মাটি, রাবিশ ফেলে সড়কের ১৫-২০ ফুট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। উন্নয়ন হবে ভালো কথা, জনগণের চলাচল বন্ধ করা তো ঠিক নয়। দুর্ভোগের তো একটা সীমা আছে।
মেট্রোরেল ও উড়ালসড়ক প্রকল্পের শুরুতেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়েছে। ওই ছাড়পত্রে নির্মাণকালীন পরিবেশ ও শব্দদূষণ না করা, মানুষের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত না করা, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়ক দখল না করাসহ বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। স¤প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর উড়াল সড়ক ও মেট্রোরেল নির্মাণকারী সংস্থাকে শব্দ ও ধুলাদূষণ কমানোর বিষয়ে চিঠি দিয়েছে। মেট্রোরেলের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তারা টাকা দিয়েছেন। কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি পাঁচ-ছয়টি সংস্থা। কাজটা জটিল। মানুষের ভোগান্তি কমাতে সংস্থাগুলোর ওপর তারা চাপ রাখছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরাতুল্লাহ বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে সড়ক খননের অনুমোদন দেয় ওয়ানস্টপ সেল থেকে। তবে সেল থেকে এই দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়, খননের কারণে যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়।



 

Show all comments
  • MD Elias ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১:২৬ পিএম says : 0
    ai vogantir ses kothay ?
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১:২৬ পিএম says : 0
    Thanks to the reporter
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভোগান্তি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ