চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
\ এক \
ইদানীংকার কথিত আধুনিক নারীরা পর্দা না করার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি ও অজুহাত দায়ের করে থাকে। এ প্রেক্ষিতে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। তাতে নানাজনের কাছ থেকে নানা অজুহাত ও কারণ বেরিয়ে এসেছে।
‘কেন পর্দা করেন না?’ এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার নারীদের কাছে। জবাবে তারা যেসব কারণ দেখিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দশটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদগণ চেষ্টা করেছেন এগুলোর উত্তর খোঁজার। ঐ কারণগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে আমরা খুঁজে পেয়েছি এসব অজুহাতের অসারতা।
এ পর্যায়ে আমরা গুরুত্ব অনুসারে সেসব কারণ এবং সংক্ষেপে এই কারণগুলোর ব্যাপারে আমাদের আলোচনা উপস্থাপন করবো ইনশাআল্লাহ। যারা পরিপূর্ণ পর্দা পালনে আগ্রহী নন, কিংবা পর্দার গুরুত্ব বোঝা সত্তে¡ও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে পর্দা শুরু করতে পারছেন না আশা করি এ লেখাটি তাদের মনে পর্দা পালনের প্রতি উৎসাহ যোগাবে।
প্রথম অজুহাত : যারা পর্দা পালনে আগ্রহী নয়, তাদের অন্যতম অজুহাত হলো, ‘হিজাবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই।’
জবাব : এবার আমরা এ অজুহাত সম্পর্কে আলোচনা করবো। এই অজুহাত যিনি দেখান, তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, আপনি কি ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত? তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি এর উত্তর দেবেন- ‘হ্যাঁ’। কারণ, তিনি এই ঘোষণা দিয়েছেন যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য উপাসনার যোগ্য নয়। এর মানে তিনি ইসলামিক বিশ্বাসের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। এরপর তিনি যখন বলেন- ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বার্তাবাহক ও রাসূল, এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি ইসলামিক শরিয়া ও এর বিধিবিধানের ব্যাপারেও সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস স্থাপন করেন।
অতএব বলা যায়, এই কালিমা যিনি ঘোষণা করেছেন দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে তিনি ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। তিনি বোঝেন যে, ইসলামিক জীবনব্যবস্থাই সেই জীবনব্যবস্থা যার অনুসরণে একজন মানুষের জীবনের সকল কাজ সম্পন্ন হওয়া উচিত। সুতরাং ‘পর্দার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত নই’ প্রশ্ন মৌখিক হলেও তা হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে নয়।
দ্বিতীয় অজুহাত : নারীবাদীদের আরেকটি অজুহাত হলো, ‘হিজাবতো ইসলামিক বিধিবিধান তথা শরিয়তের অংশ নয়।’
জবাব : যে মুসলিম বোন পর্দার ব্যাপারে এমন অজুহাত দায়ের করেন, এই বোনটি যদি নিয়তের ব্যাপারে সৎ ও আন্তরিক হন এবং সত্য জানার উদ্দেশ্যে বিষয়টি বিবেচনা করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন যে, হিজাব বা পরিপূর্ণ পর্দাবিধান অবশ্যই ইসলামিক শরিয়তের অংশ। যা নারীদের জন্য অবশ্যপালনীয়। কারণ স্রষ্টা, পালনকর্তা, প্রভু হিসেবে যেই আল্লাহকে তিনি মেনে নিয়েছেন, সেই আল্লাহই তাঁর ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনে হিজাবের আদেশ দিয়েছেন। তাছাড়া যে নারী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা সত্য বলে স্বীকার করেন, সেই নবীই তাঁর হাদিসে নারীদের হিজাবের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন- আপনি বিশ্বাসী মুসলিম নারীদের বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে; তাদের সতীত্ব রক্ষা করে; একান্ত প্রয়োজনে মুখমন্ডল ও হাতের কব্জি বাদে তাদের দেহের অন্যান্য অংশ উন্মুক্ত না করে। তারা যেন চাদর দিয়ে সারা শরীর মুড়ে নেয় এবং নিজেদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, সৎছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, মুসলিম নারী, মালিকানাধীন দাসী, অধীনস্থ বৃদ্ধ এবং নাবালক শিশুদের ছাড়া অন্যদের কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। [সূরা আন-নূর, ২৪ : ৩১]
কুরআন মাজিদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- হে নবী! আপনি স্বীয় স্ত্রী-কন্যাদের ও বিশ্বাসী মুসলিম পুরুষদের স্ত্রীদের বলুন! তারা যেন নিজেদের গায়ে আবরণ টেনে দেয়। এতে তারা সম্ভ্রান্ত মহিলা হিসেবে পরিচিতি পাবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। [সূরা আল-আহযাব, ৩৩ : ৫৯]
মূলত যারা প্রকৃত অর্থেই ইসলামের ওপর দৃঢ়বিশ্বাস রাখেন, দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে আদর্শ মানেন, তারা অবশ্যই ইসলামের বিধিবিধানের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে থাকতে পারেন না।
তৃতীয় অজুহাত : যেসব মুসলিম তরুণী পর্দা পালনে আগ্রহী নন, তাদের অন্যতম অজুহাত হলো, ‘ইসলামী পোশাকের ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে হিজাব পরতে বারণ করেন। বাবা-মার আদেশ মানা তো অনেক সাওয়াবের কাজ।’
জবাব : এবার আমরা তরুণীর এই অজুহাতের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। মূলত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অজুহাতের জবাব বহু আগেই দিয়ে গেছেন। প্রজ্ঞাগুণে অল্প কয়েকটি কথায় তিনি এর উত্তরে বলেছেন- ‘যে কাজে স্রষ্টার অবাধ্যতা করা হয়, সেই কাজে স্রষ্টা ব্যতীত অন্য কারো বাধ্য হওয়া যাবে না। [আহমাদ : ১০৪১]
এ ব্যাপারে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় যে, ইসলামে মা-বাবার মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। বিশেষ করে মাকে দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা। আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের মতো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয়ের সঙ্গে একই আয়াতে মা-বাবার সাথে ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহর উপাসনা করো, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। আর মা-বাবার সাথে ভালো আচরণ করো।’ [সূরা আন-নিসা, ৪ : ৩৬]
কুরআনের এ আয়াতের আলোকে সকল ক্ষেত্রেই মা-বাবার বাধ্য থাকতে হবে। শুধুমাত্র একটিমাত্র ক্ষেত্র ছাড়া। আর তা হচ্ছে, মা-বাবা যদি কখনো এমন কোনো কাজ করতে বলেন, যেটি আল্লাহর বিধিনিষেধের নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে। তাই আল্লাহ তাআলার দেয়া পর্দাবিধান বাদ দিয়ে অন্য কারো মনোস্তুষ্টি উচিত নয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা যদি এই চেষ্টা করে, যাতে তুমি আমার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের আনুগত্য করা উচিত নয়।’ মনে রাখতে হবে যে, মা-বাবা পৃথিবীতে সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ এবং তাদের সন্তুষ্টির মাঝেই নিহিত রয়েছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তবে হ্যাঁ, অন্যায় কাজে তাদের অবাধ্য হওয়া আনগত্য পরিপন্থী হবে না। এর মানে এই নয় যে, আমরা তাদের সাথে ভালো আচরণ করবো না, তাদের যত্ম নেবো না। কারণ, এই একই আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ বলে দিয়েছেন- “তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে।”
চতুর্থ অজুহাত : যারা পর্দাবিধান মেনে চলেন না, তাদের আরেকটি অজুহাত হলো, ‘আমি যাদের সাথে যে সমাজে চলাফেরা করি, সেখানে আমার বর্তমান ড্রেসআপ বাদ দিয়ে ইসলামিক পোশাক মেনে চলা সম্ভব নয়।’
জবাব : মূলত যারা পর্দা পালনে আগ্রহী নয়, কিংবা ইসলামী পোশাক পরতে চায় না, তাদের এ ধরনের অজুহাতের পেছনে ইসলামী চিন্তাবিদগণ দুটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমত, হিজাবের ব্যাপারে তিনি হয়তো আন্তরিক ও সৎ বটে; কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় হিজাব নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় ভুগছেন। দ্বিতীয়ত, এমনও হতে পারে যে, হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মেলাতে যেয়ে তিনি শুধু মাথায় রংচ্ছটা স্কার্ফ পরেন; পরিপূর্ণ পর্দার ব্যাপারে মোটেও আন্তরিক নন।
আসলে এ ধরনের তরুণীর ব্যাপারে বলা যায় যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থান ও মানসম্মানের ভয়ে তিনি পর্দা করতে পারছেন না। তাঁর প্রতি ইসলামী চিন্তাবিদগণের পরামর্শ হলো- বোন! আপনি কি এটা জানেন না যে, পরিপূর্ণ পর্দার শর্ত পূরণ না করে কোনো অবস্থাতেই একজন নারীর ঘর থেকে যে কোনো প্রয়োজনেই হোক বের হওয়ার অনুমতি আল্লাহ দেননি? প্রতিটি মুসলিম নারীরই দায়িত্ব ইসলাম তাঁদের কী মর্যাদা দিয়েছে এবং ইসলাম তাঁদের কী করতে বলেছে, সেগুলো জানা। সর্বোপরি ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম আবশ্যিক জ্ঞান অর্জন করা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।