পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
রেজাউল করিম রাজু : এক ফারাক্কাই উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এ মরণ বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে এপারের এককালের প্রমত্তা পদ্মা মরে গেছে। শুধু নদী মরেনি বাংলাদেশের এক বিশাল অংশের শুধু জীববৈচিত্র্যে সর্বনাশ করেনি।
ধ্বংস করেছে এদেশের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কৃষি শিল্প, বনসম্পদ ও প্রাণ বৈচিত্র্য। প্রমত্তা পদ্মা বিশাল বালুচরের নিচে চাপা পড়ার সাথে এর অসংখ্য শাখা নদ-নদী পড়েছে অস্তিত্ব সঙ্কটে। ফারাক্কা চালুর পূর্ববতী সময়ের প্রবল খর¯্রােতা নদীগুলো রূপ নিয়েছে খালে। বিগত চল্লিশ বছরে পদ্মার বুকে বালু জমতে জমতে এক-দুই করে প্রায় কুড়ি মিটার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এক সময় যে পদ্মায় ত্রিশ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারত এখন তা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। পদ্মা প্রবহমান থাকার ফলে এর শাখা নদীগুলো থাকত পানিতে টইটুম্বর। মূল প্রবাহ কমে যাবার কারণে পদ্মার সাথে সাথে শাখাগুলো হেজেমজে গেছে। নাব্যতা হারিয়েছে। বড়াল, নবগঙ্গা, মধুমতি, হিসনা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, কুমার, আত্রাই, চিকনাই, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, বন্দনাসহ পদ্মার নব্বইটি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জমে বড়-ছোট অনেক চর। অনেক নদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। কারো মানচিত্রে অস্তিত্ব রয়েছে এসব নদীর। আবার অনেক নদীর নামও নেই মানচিত্রে। নামে নদী হলেও খালের চেয়ে অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অথচ এক সময় নদীকেন্দ্রিক ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় একটা অংশ হতো নৌপথে। কারণ নদীপথে পণ্য পরিবহন ছিল সহজ ও সুলভ। ফলে পণ্যের দামও কম থাকত। এখনও শুধু নাম নিয়ে বেঁচে আছে শত শত নৌঘাট আর বন্দর। জাহাজ আর বড় বড় মহাজনী নৌকা ভিড়ত এসব ঘাটে। আজ সবই অতীত। শুধু বণিক নয়, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী স্বপ্নময় পদ্মা আজ দুঃস্বপ্নের হাহাকারে বিদীর্ণ। নদী মরে যাবার সাথে সাথে নদীকেন্দ্রিক পেশাজীবী মানুষ বেকার হয়ে ভিন্ন পেশা নিয়েছে। বিশেষ করে জেলে-মাঝিরা এখন আর তাদের বাপ-দাদার পেশায় নেই। কেউ কৃষি কাজ করে। কেউ রিকশা প্যাডেলে পা রাখাসহ বিভিন্ন পেশায় চলে গেছে। হারিয়ে গেছে মাছসহ জলজ জীববৈচিত্র্য। আর নদীভাঙনে প্রতি বছর উদ্বাস্তু হচ্ছে হাজারো মানুষ। চল্লিশ বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়। সেই পরীক্ষা আজো শেষ হয়নি। পানি আটকে এপারের মানুষের ওপর নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে ওপারের পানি জল্লাদরা। পদ্মার বিস্তৃত এলাকাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার পরও আরো আঁটোসাঁটো পানি আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে ওপারের ক্ষমতাসীন দাদা-দিদিরা। ভাটির দেশ বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নীতিতে সবাই একাট্টা। বন্যার সময় ডুবিয়ে মারা আর খরার সময় শুকিয়ে মারার পরীক্ষায় সফল হয়েছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গঙ্গা-পদ্মার পানি নিয়ে প্রতারণা অব্যাহত রয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন নামে ভারত বাংলাদেশের এক গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়া চুক্তি রয়েছে। দু’দশক পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। বরং প্রতারণার শিকার হয়েছে। ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা ও এর উপনদীগুলোর ওপর বাঁধ দিয়ে খাল কেটে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক এ নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রবাহে বিঘœ ঘটানোর ফলে মূল গঙ্গা তার উৎস হারিয়ে যেতে বসেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নব্বই ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে মাত্র দশ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পানির জন্য হাহাকার করলেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার অজুহাতে শুষ্ক মওসুমে পানি থেকে বঞ্চিত করে শুকিয়ে মারছে। আবার বর্ষা মওসুমে ওপারের বন্যার চাপ সামাল দিতে ফারাক্কার ১০৯টি গেটের সবক’টি একসাথে খুলে দিয়ে এপারে পানি ঠেলে দিয়ে ডোবাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ফারাক্কার দু’টি নড়বড়ে গেটের চিপা দিয়ে কিছু পানি বেরিয়ে আসায় সর্বনাশ হয়ে গেল বলে হৈ চৈ ফেলে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আরেকটা ব্যারাজ নির্মাণের দাবি করা হয়। অথচ এ ফারাক্কার কারণে ভারতের বিহার রাজ্যে সর্বগ্রাসী বন্যা দেখা দিচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিস কুমার ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেবার দাবি জানিয়েছেন। এক জনসংলাপে শুধু নয়, ভারতের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা তুলে ধরে বলেন ফারাক্কার ব্যারাজের কোনো সুফল নেই। যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ আলোড়ন তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ নব্বই দশকেই গঙ্গা ভাঙনের ইতিকথা বইতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এবং ব্যারাজ অকেজো হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালে ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের নয়জন নাগরিক ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। সম্প্রতি দৈনিক আজকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ব্যারাজের ছয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিটের মধ্যে পাঁচটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ গঙ্গার পানি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরিয়ে নেয়ায় ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি আসছে না। ১৯৭৬ সালেই মওলানা ভাসানী লংমার্চ করে মরণ বাঁধ ফারাক্কা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও বলে আওয়াজ তুলেছিলেন লাখো মানুষকে সাথে নিয়ে। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণের সময় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন। ১৮৫১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত চালানো সমীক্ষায় নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করে ১৯৫৭ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গের সে সময়কার প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন বলে তাকে এখন তারা পাকিস্তানের এজেন্ট বলে বিদ্রƒপ করেছিল। পরে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ড. ইপেনকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হলে তিনিও ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, এ বাঁধটিকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেসব মতামত উপেক্ষা করে ভারত ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে। অথচ এখন সেসব বিশেষজ্ঞের অভিমত ভয়াবহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ তো বটে ভারতের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দাবি উঠেছে বাঁধ ভেঙে দাও। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা যায় ফারাক্কার কারণে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে পাঁচশ’ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রায় চুরানব্বই হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। এছাড়া জীববৈচিত্র্য প্রকৃতি পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা কোনো অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। গঙ্গার পানি অনৈতিকভাবে প্রত্যাহার করে নেবার প্রতিবাদ উঠছে নেপালেও। ক’দিন আগে পদ্মার তীরে সমাবেশ করল নেপাল থেকে আসা ‘ওয়াটার কমন্স ফোরাম’ নামের একটি সংগঠন। নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নদী সুরক্ষা যাত্রা-২০১৭ শুরু করেছে। এরা ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি নেপালের গন্ডাক নদী ও ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের গঙ্গাপাড়ের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করে। এরপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও মহানগরীর আলুপট্টির নিকট পদ্মার তীরে সমাবেশ করে গঙ্গার ওপর ব্যারাজ নির্মাণের ফলে কি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা তুলে ধরেন। সরেজমিন এসে ভয়াহতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ করেন। তারা বলেন, গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কারণে নেপাল-ভারত-বাংলাদেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নেপালের হিমালয় থেকে গন্ডাক নদীর মাধ্যমে ভারতের গঙ্গায় পানি আসে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে ভরা মওসুমে গন্ডাক নদী থেকে পানি আসতে পারছে না। ফলে নেপাল ও ভারতে বন্যা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে পানিশূন্যতায় ভুগছে বাংলাদেশের পদ্মা। ফলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতিতে চরম বিরুপ প্রভাব পড়েছে। ভারত ও নেপালেও বন্যার কারণে বহু সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। প্রতিনিধিদলের পক্ষে বক্তব্য দেন নেপালের মহিলা অধিকার মঞ্চের কল্পনা বিন্দু নদী রক্ষা কমিটির সহ-সভাপতি পবিত্রা নিউপালে। তারা বলেন, তিন দেশের নদীপাড়ের বাসিন্দাদের কাছ থেকে নদীকেন্দ্রিক ভয়াবহ সমস্যার কথা জানা গেছে তা তিন দেশের সরকারকেই অবহিত করা হবে। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহে নৌ চলাচলবহির্ভূত ব্যবহার সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নে তারা তিন দেশের সরকারকে তাগাদা দেবেন। এতে বলা হয়েছে, কোনো দেশ এককভাবে বা যৌথভাবে এমন প্রকল্প প্রণয়ন করতে পারে না যাতে অন্য কোনো দেশ বা জাতি বা নদীপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ রাজনৈতিক কারণে এই আইনে অণুস্বাক্ষর করেনি। ভারতও নিজের দেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় আন্তর্জাতিক এই আইন স্বাক্ষর না করায় বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বলি হচ্ছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেবার জন্য তারা দিল্লির কাছে দাবি জানাবেন বলে উল্লেখ করেন। আজ বাংলাদেশ-নেপাল-ভারত সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে মরণ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করার পর তা যদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা ভেঙে ফেলার বহু নজির আছে বিশ্বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন পাঁচ হাজার বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। জাপানেও প্রায় তিন হাজার বাঁধ অপসারণ করেছে। চীনও এরকম উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু বাঁধ সরিয়েছে। সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারতও ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেবার পদক্ষেপ নিতে পারে। আর তাহলে বাংলাদেশ বাঁচবে। ভারতের উপকার বই ক্ষতি হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।