Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

উঠতি মাস্তান ও কিশোর সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দক্ষিণাঞ্চল

| প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বরিশাল ব্যুরো : বরিশাল মহানগরীসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল উঠতি ও ছিচকে মাস্তানের সাথে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিশোর সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গত কয়েক বছরে এসব মাস্তানের বেপরোয়া কর্মকান্ডে অনেক রক্ত ঝরলেও তাদের দমনে আইনÑশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। তবে যে কোনো বড় ধরনের অঘটনের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেলেও সময়ের ব্যবধানে এর প্রায় সবটাই মিলিয়ে যায়। অথচ এসব ছিচকে মাস্তান ও কিশোর সন্ত্রাসীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ও নেই। পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে। উঠতি ও ছিচকে মাস্তানদের বেশির ভাগই বখাটে হলেও কিশোর সন্ত্রাসীদের প্রায় সবাই বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র। এরা একদিকে ক্রমাগত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, আবার এদের দ্বারা সহপাঠীসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্রমাগত নিগ্রহেরও শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরাও ক্রমাগত ইভটিজিংয়ের শিকার হলেও তার তেমন কোনো প্রতিকার নেই। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীরা পর্যন্ত তাদের সহপাঠীদের দ্বারা নানা ধরনের উৎপীড়নসহ নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন বলে চাপা ক্ষোভসহ হতাশাও বাড়ছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
কিশোর সন্ত্রাসের সর্বশেষ শিকার হয়েছে বরিশালের সরকারি শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র হৃদয়। গত শনিবার সকালে স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের কাছে পরেশ সাগর মাঠের কাছে তাকে চাকু দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাশেরই টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কতিপয় কিশোর সন্ত্রাসী। হৃদয়কে বাঁচাতে তার দুই সহপাঠীও গুরুতর আহত হয়। ওই বিবেকহীন হামলায় অংশ নেয়া আটজনের মধ্যে মহানগর পুলিশ ইতোমধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। ফেরার দুজনকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীলগণ। গ্রেফতারকৃত ছয়জনের মধ্যে ইতোমধ্যে চারজনই ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দীতে হৃদয়কে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা প্রায় সবাই হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, কুপিয়ে জখমের জন্য ওই হামলা চালানোর কথা বলেছে। আর এ হামলার পেছনে প্রেমঘটিত ঘটনা জড়িত বলেও জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
সাম্প্রতিককালে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়েই স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা অবাধ মেলামশাকে ‘উদারমনা সংস্কৃতি’ হিসেবে বিবেচনা করে বিষয়টি নিয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এমনকি গত তিন বছরে বরিশাল মহানগরীতে যে অন্তত ৫০টি নানা ধরনের রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, সেখানে উঠতি বয়সের স্কুল-কলেজগামী ছেলেÑমেয়ারা দিনÑরাত অড্ডা দেয়। আর এ সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতায় একই ছাত্রীর পেছনে ছুটছে একাধীক কিশোর ও সহপাঠী। আর তা নিয়ে বৈরিতা অনেক সময়ই শক্তি প্রয়োগ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে বছর তিনেক আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে খুন করে বখাটে সন্ত্রাসী। সে ঘটনায় ওই সন্ত্রাসীকে জেলা আদালত ফাঁসির হুকুম দিয়েছে। এর আগে বরিশাল জেলাস্কুলের ছাত্র শামি-ইনান কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতেই নিহত হয়েছে। ওই স্কুলের আরো ছাত্র নিজ বাসভবনে নিহত হয় বছর পাঁচেক আগে। সে মামলায় বাবা-মা ও গৃহ পরিচারিকাকে আসামি করে চার্জশিট দেয়ার পরে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সবাইকে বেকসুর খালাশ দেয় বিজ্ঞ আদালত। মহানগরীর অপর অভিজাত উদয়ন স্কুলের এক ছাত্র ইতোপূর্বে কাম্পাসে নিহত হয় সন্ধ্যার পরে। সে মামলার বিচার এখনো হয়নি। গতবছর টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের অদূরে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গেটে ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি আঘাতে নিহত হয় ছাত্রলীগের এক নেতা। সে মামলায় চার্জশিট দাখিলের পরে বাদী নারাজী প্রদান করে। এ হত্যাকান্ডটি দলীয় অন্তর্দ্ব›দ্ব হলেও অন্য হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলোর পেছনে কিশোর সন্ত্রাসীদের অধিপত্যের লড়াইসহ মেয়েঘটিত বিষয় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এখন খোদ বরিশাল মহানগরীতে স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদেরও অবাধ মেলামেশাসহ দিনরাত আড্ডা দিতে দেখা যায়। নগরীর কয়েকটি পার্কসহ বিনোদন কেন্দ্রের পাশাপাশি নতুন গড়ে ওঠা মিনি চায়নিজসহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে এখন সাধারণ মানুষের প্রবেশ অনেকটাই অসম্ভব হয় উঠেছে এসব উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের আড্ডার কারণে। এমনকি অনেক রেস্তোরাঁর মালিকগণও বিষয়টিকে প্রশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও পার্কগুলোতে অনেক রাত পর্যন্ত স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের আড্ডার বিষয়টি ইতোমধ্যে অনেকটা জায়েজ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। নগরীর বিবির পুকুর পাড়, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, স্বাধিনতা পার্ক ও হাতেম আলী কলেজ লেকের পাড়ে অনেক রাত পর্যন্তই চলছে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণীর আড্ডা। এসব আড্ডাস্থলে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকের ছড়াছড়িরও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানের ওয়াকওয়েতে এখন হাটতে সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনায় পড়ছেন কিশোর-কিশোরীদের আড্ডাবাজির কারণে।
আর এসব আড্ডায় যোগ দেয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ উঠতি মাস্তানরাও জড়িত রয়েছে। এসব আড্ডা থেকেই মেলামেশার সূত্রপাত হচ্ছে। সেখান থেকেই শুরু হয় প্রেম নিবেদনের প্রতিযোগিতা। যা পরবর্তীতে বল প্রয়োগ পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধীক কিশোরী আবার তাদের অসহায়ত্বের কথাও জানিয়েছে। বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি জেলা শহরে প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল দেশের অন্য সব শহরগুলোর তুলনায় খারাপ হচ্ছে। এমনকি ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফল ভালো হচ্ছে। গ্রামের চেয়ে এ অঞ্চলের কোচিংনির্ভর শহরের ছেলে-মেয়েদের ফলাফল ক্রমশ অবনতির দিকে। এসব নিয়ে অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন হলেও জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ অনেকটাই নিরুদ্বিগ্ন।
‘ইভটিজিং’এর মতো সামাজিক ব্যাধী সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ইতোমধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়লেও তা থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ নেই। এসব ইভটিজিংয়ের সাথে উঠতি মাস্তান ও ছিচকে মাস্তানরাই সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু হৃদয় হত্যাসহ প্রতিটি হত্যাকান্ডের পর বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে ছাত্র-ছাত্রীরা। ইভটিজিং নিয়েও অতীতে অনেক সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে। কিছুদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরও থাকে, তার পর সবই আগের চেহারাই ধারণ করে।
এসব বেপরোয়া অনৈতিক কর্মকান্ডে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মন্ডলীসহ অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়ছে। বেশির ভাগ ছাত্রীও উদ্বিগ্ন। পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকেও মাঝেমধ্যে নানা অভয় বাণী প্রদান করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কথাও। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি এখনো দৃশ্যমান নয়।
এসব বিষয়ে গতকাল মহানগর পুলিশ কমিশনারের সাথে যোগাযোগের লক্ষ্যে তার অফিসে ও সেলফোনে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ