পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সমাজে ব্যাপকহারে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সামাজিক অপরাধের ক্রমবিস্তৃতি এবং যুব সমাজের একটি অংশের মধ্যে নির্মমতা ও পৈশাচিক অপরাধ প্রবণতার বিস্তার এর প্রমাণ। সম্প্রতি সিলেটে এক কলেজ ছাত্রীকে জনৈক ছাত্রনেতার চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্য কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করার ভিডিও ক্লিপিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সমগ্র জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সেই সাথে যুব সমাজের এমন নির্মম ও হিংস্র হয়ে ওঠার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটও মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে। দিনে দুপুরে কলেজ ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ছাত্র নামধারী এক সন্ত্রাসী কোপাচ্ছে আর আশপাশের সবাই তা’ দেখেছে, কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এহেন বাস্তবতার মধ্যেও মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও মানবিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাওয়ার জন্য তার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকায় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশাকে এভাবেই প্রকাশ্য ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছিল এক বখাটে যুবক। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এমন অন্তত অর্ধশত ঘটনার উদাহরণ আছে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা তরুণদের মধ্যে এমন বেপরোয়া নির্মমতা, পৈশাচিকতাসহ নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য দেশে বিরাজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং অপরাধীকে ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বদলে রাজনৈতিক ব্লেইম গেমের সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন জঙ্গি-সন্ত্রাসী নির্মূলে জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে, তখন সারাদেশে পেশাদার চিহ্নিত অপরাধীদের পাশাপাশি উঠতি বয়েসী অসংখ্য নতুন মুখ অপরাধ জগতে পা’ রাখছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ এবং আভ্যন্তরীণ অপরাধ ও সামাজিক সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উভয়ক্ষেত্রে দেশের তরুণ সমাজই এসব অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানসহ নানা ধরনের তৎপরতা দেখা গেলেও ঢাকাসহ সারাদেশে উঠতি তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাড়তি নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি কয়েক বছর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের আটটি বিভাগে উঠতি বয়েসী অপরাধীদের যে তালিকা করা হয়েছিল, পরবর্তীতে এসব তালিকা ধরে তাদের উপর নজরদারি করা বা নতুন যুক্ত হওয়া অপরাধীদের নাম সংযুক্ত করে তালিকা হালনাগাদও করা হয়নি। অথচ সাম্প্রতিক অপরাধ প্রবণতায় এই উঠতি বয়েসী নতুন মুখদেরই বেশী সক্রিয় ও বেপরোয়া দেখা যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ তরুণরাই ছিনতাই-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, যত্রতত্র অস্ত্র প্রদর্শন, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে নির্বিঘেœ চলে যাচ্ছে। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনা, মুখ খুলতে সাহস পায়না। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মকা- দমনের ব্যস্ততা না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ যেন শুধুমাত্র জঙ্গিবাদ নির্মূলের দিকে। উঠতি সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ, মাদকসেবি ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি যেন গৌণ হয়ে গেছে।
ছোট-বড় সব বয়েসী সন্ত্রাসী ও অপরাধীর হাতে রয়েছে হাজার হাজার আগ্নেয়াস্ত্র। এদের অনেকেই আবার অস্ত্র ও মাদক কেনাবেচার সাথেও জড়িত। অর্থাৎ একজন উঠতি বয়েসী অপরাধী নিজে যেমন বহুমাত্রিক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, আবার অন্যের হাতে অস্ত্র ও মাদক তুলে দিয়ে সামাজিক সন্ত্রাস-অপরাধ ও মাদকাসক্তির বিস্তার ঘটাচ্ছে। দেশের উঠতি বয়েসী তরুণদের এই বিপথগামিতার পথ অবারিত রেখে সামাজিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও সমাজ প্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সন্ত্রাসী অপরাধীদের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়া অস্ত্র এবং মাদক আসছে প্রধানত ভারত ও মিয়ানমার থেকে। সীমান্ত পথে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের রুট বন্ধ না করে দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যত উদ্যোগই নিক, তা’ তেমন ফলপ্রসূ হবেনা। জঙ্গিবাদ মোকাবেলার পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী, প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা উঠতি সন্ত্রাসীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। অস্ত্র উদ্ধার, মাদকের ব্যবহার ও কেনাবেচা বন্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। দাগী অপরাধীদের পাশাপাশি উঠতি বয়েসী সন্ত্রাসী, মাদকসেবিদের হালনাগাদ তালিকা তৈরী করে তাদের নিবৃত্ত করে সুপথে আনার বিকল্প সামাজিক প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে। অপরাধ দমনের নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং গ্রেফতার বাণিজ্য করলে এ ধরনের জাতি-সমাজবিধ্বংসী অপরাধ ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বন্ধ হবেনা। সমাজে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই রাষ্ট্রের পক্ষে অপরাধ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী পন্থা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।