পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
নূরুল ইসলাম : অবৈধ কারখানার ছড়াছড়ি পুরান ঢাকায়। ১০টি থানা এলাকাজুড়ে ২৫ হাজার ছোট বড় কল-কারখানা লাখ লাখ মানুষের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করছে ওই সব ভবন ও আশপাশের বাসিন্দারা। অবৈধ এসব কারখানায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার পর আবাসিক এলাকা থেকে কারখানাগুলো স্থানান্তরের দাবি তোলা হয় বিভিন্ন মহল থেকে। মিছিল, বিক্ষোভ, মানবন্ধন হয়। শোক আড়াল করার জন্য জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম প্রতিশ্রুতি আসে। সময়ের বিবর্তনে এক সময় সব ধামাচাপা পড়ে যায়। অনাকাক্সিক্ষত আরেকটি দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে ক্ষেত্র। এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরান ঢাকার লাখ লাখ বাসিন্দা। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর কেমিক্যাল গোডাউনে সংঘঠিত এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকানপাট ও কারখানা। এতো বড় দুর্ঘটনার পরেও পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের গোডাউন এখনও আছে। একই সাথে বাড়ছে ছোট বড় কল-কারখানা। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সারওয়ার হাশেমী ইনকিলাবকে বলেন, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানাগুলো পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকারের নির্দেশনা পেলে এগুলো সরানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর এসব কল-কারখানাকে কখনওই অনুমোদন দেয়নি। যুগ যুগ ধরে অনুমোদন ছাড়াই এগুলো চলছে।
রাজধানীর ১০টি থানা এলাকাকে পুরান ঢাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলোÑ লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী ও সূত্রাপুর। তবে এই দশ থানা ছাড়াও রাজধানীর অন্য থানা এলাকায়ও আরো অনেক অবৈধ কারখানা আছে। পুরান ঢাকায় যে সব অবৈধ কারখানা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ড্রাইসেল বা ব্যাটারি কারখানা, নকল ওষুধ তৈরির কারখানা, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরির কারখানা, পলিথিনের দানা, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, নকল বৈদ্যুতিক তার, আচার, চকোলেট, বিস্কুট তৈরির কারখানা ও বেকারি, ঝালাই কারখানা, রেক্টিফায়েড স্পিরিট ব্যবহার করে নানা সুগন্ধি ও আতর তৈরির কারখানা, আতশবাজি ও পটকা কারখানা, সাইকেল, খেলনা, নকল কসমেটিকস ও গহনা তৈরীর কারখানা, জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কারখানা, রাবার ফ্যাক্টরি, রং, সলিউশন তৈরির কারখানা, ব্লিচিং পাউডার ও সাবান তৈরীর, নকল টিভি, ফ্রিজ তৈরীর কারখানা, নকল ফ্যান কারখানা, ইলেকট্রিক ব্যাকোলাইট কারখানাসহ শতাধিক পণ্য তৈরির কারখানা। অবৈধ হলেও এসব কারখানার উৎপাদন ও সরবরাহ চলে প্রকাশ্যে। এমনকি বেশিরভাগ কারখানা চলে চোরাই বিদ্যুতে।
কদমতলীর পাটেরবাগ, মুরাদপুর ও কোদারবাজার এলাকায় ৭ সহস্রাধিক ব্যাকোলাইট কারখানা আছে যেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। বেশিরভাগ কারখানা চলে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে বিদ্যুৎচোরের গডফাদার নাসিরের সংযোগে চলে ব্যাকোলাইট কারখানাগুলো। বিনিময়ে কারখানার মালিকরা মাসে মেশিনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে দেয় নাসিরকে। মুরাদপুরের এক কারখানার মালিক জানান, ব্যাকোলাইট মেশিন চালাতে অনেক বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। বৈধভাবে বিদ্যুৎ নিলে এ ব্যবসায় লাভ করা কষ্টকর। সে কারণেই বেশিরভাগ ব্যবসায়ী চোরাই লাইন নিয়ে ব্যাকোলাইট মেশিন চালায়। আর এ কাজে বহু আগে থেকে সিদ্ধহস্ত নাসির। আরেক ব্যবসায়ী জানান, ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের অভিযানের পর নাসির বেশ কিছুদিন ব্যবসা বন্ধ রেখেছিল। জুরাইন বিদ্যুৎ অফিসকে ম্যানেজ করে আবার আগের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে ব্যাকোলাইট মেশিনের কারণে মুরাদপুর, পাটেরবাগ ও কোদারবাজার এলাকার মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা চাই এগুলো বন্ধ হোক। কিন্তু আমাদের কথা কার কাছে বলবো? কদমতলী থানার শ্যামপুর এলাকাতেও রয়েছে নানা রকমের কারখানা। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় নকল কারখানার ছড়াছড়ি। নকল মিনারেল ওয়াটার থেকে শুরু করে মশার কয়েল, সাবান, দুধ, গুঁড়, আটা, ময়দা, ওষুধ, ফ্যান, পানের জর্দা, দই, মিষ্টি, ঘি, মাখন, ইলেকট্রিক ক্যাবল, ধান ভাঙ্গানো মেশিন, টিউবওয়েল, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন রকমের কয়েকশ’ কারখানা আছে এই থানা এলাকায়। এর মধ্যে দনিয়া এলাকাতেই মিনারেল ওয়াটারের কারখানা আছে অর্ধশতাধিক।
লালবাগ ও হাজারীবাগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য অবৈধ কারখানা। বাসাবাড়িতে এগুলো গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে পলিথিন কারখানাসহ প্লাস্টিক, ইলেকট্রিক সরঞ্জামাদির কারখানা আছে কয়েকশ’। সরেজমিনে দেখা গেছে, লালবাগের অলিতে-গলিতে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে এমন সব দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ। সালফার, পটাশ, ফসফরাস, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ইথানল, মিথাইল, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ফরমালডিহাইড, এডহেসিভ বা সলিউশন, তারপিনসহ নানা ধরনের গানপাউডার বিক্রি হয় যত্রতত্র। স্থানীয়রা জানান, এসব ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক এলাকারই বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গোডাউন বানিয়ে অনিরাপদ ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে এমনিভাবে গুলজার নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে রাসায়নিক পদার্থ রাখা হয়েছিল। যেখান থেকে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সূত্রপাতে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।
সরেজমিনে কয়েকটি কারখানা পরিদর্শনকালে এগুলোর মালিক বা কর্মচারী অকপটে স্বীকার করেছেন কারখানাগুলোর অনুমোদন না থাকার কথা। ধোলাইখালের এক কারখানার মালিক বলেন, অনুমোদন বলতে আমরা সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সকে বুঝি। এ ছাড়া কোনো কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। নবাবগঞ্জে সরকারী জমিতে গড়ে উঠেছে জুতা, প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিক কেবল, বেকারী, চকোলেটসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা। এই এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে কারখানার ছড়াছড়ি। কোনো কোনো কারখানাকে আবার বিক্রয় কেন্দ্র বলে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। জানতে চাইলে হোসেন ট্রেডার্সের মালিক বলেন, কারখানার সাইনবোর্ড লাগালে ঝামেলা হয়। এজন্যই বিক্রয় কেন্দ্র বলে সাইনবোর্ডে লেখা হয়। তিনিও জানান, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া তার কারখানার কোনো অনুমোদন নেই। আলাপকালে সেখানকার শ্রমিকরা জানান, অনুমোদন নেই বলেই প্রতিটা কারখানা থেকে পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাঁদা না দিয়ে কেউই এসব কারখানা চালাতে পারে না। রসুলবাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কারখানা। চারপাশে জানালা-দরজা বন্ধ রেখে গোপনে কাজ করছে শ্রমিকরা। কোথাও তৈরি হচ্ছে সুতা, কোথাও বা নকল বৈদ্যুতিক তার আবার কোথাও স্টিলের রডের ফার্নিচার। রয়েছে বেশ কয়েকটি ঝালাই কারখানা। এসব কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে এসিড জাতীয় কেমিক্যাল। চকবাজারের ডালপট্টিতে রয়েছে চকোলেট, ব্যাটারি আর খেলনা তৈরির চার শতাধিক কারখানা। ব্যাটারি কারখানাগুলোয় তৈরি হচ্ছে নানা পরিচিত ব্রান্ডের নকল পণ্য। নকল চান্দা ব্যাটারি তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, এক সাথে বহু শ্রমিক কাজ করছে। নকল পণ্য তৈরী হলেও দেয়ালে ঝুলানো ট্রেড লাইসেন্সে লেখা ‘সাধারণ ব্যবসা’।
সূত্রাপুরের সেমাই কারখানার মালিক জুয়েল, চকবাজারের জুতা কারখানার মালিক বিল্লাল, কোতয়ালীর মিনি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক শহিদ এবং বংশালের কৌটা তৈরীর কারখানার মালিক সোবহানের সাথে কথা বলে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে পুরান ঢাকা এলাকায় কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে। কেউ বৈধভাবে জিনিসপত্র তৈরী করছে কেউবা নকল জিনিস তৈরী করছে। শুধু থেকেই এসব কারখানার জন্য পুলিশ ও প্রভাবশালীদের চাঁদা দেয়ার নিয়ম। তারাও একইভাবে চাঁদা দিয়ে আসছেন। আগে হাতে হাতে চাঁদা তোলা হতো। এখন প্রতিটি এলাকায় ব্যবসাভিত্তিক মালিক সমিতি আছে। কারখানার মালিকদের কাছে থেকে চাঁদা নেয় সমিতির নেতারা। তারাই প্রভাবশালী ও পুলিশকে ম্যানেজ করে। এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নজরুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই পুরান ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এক সময় সেগুলো পরিবেশ ও মানুষের জীবনের জন্য হুমকি ছিল না। এখন অনেক কারখানাই মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের তৎপরতার সাথে আইনের শাসন থাকতে হবে। অপরাধ করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।