Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমরা এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই

প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার অভিরামপাড়ায় অবস্থিত শ্রী শ্রী সন্ত গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ ও পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়কে গত রোববার সকালে গলাকেটে হত্যা করছে দুর্বৃত্তরা। যখন প্রতিদিনের মতো নিত্যপূজার আয়োজন চলছিল, তখন মঠের পাশেই অবস্থিত তার ঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করে। এ সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে গোপাল রায় নামের একজন পূজারি আহত হন। ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আইএস, যদিও এই দায় স্বীকার নাকচ করে দিয়েছেন পুলিশ সুপার। তিনি জানিয়েছেন, এটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত হামলা কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যে কোনো বিবেচনায় এ ঘটনা উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয়। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং ঘাতকদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করি। প্রসঙ্গত, বলতে চাই, এ ঘটনাকে সম্প্রদায়বিশেষের ওপর কিংবা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুরোহিতের ওপর হামলা হিসেবে খন্ডিত বা অসম্পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখা ঠিক হবে না। একে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবেই দেখতে হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারির ৭ তারিখ পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা এর আগে সচরাচর ঘটতে দেখা যায়নি। সন্ত্রাসী হামলায় ঢাকা ও রংপুরে দু’জন বিদেশী নিহত হয়েছেন। ঢাকার হোসেনী দালান ও বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা হয়েছে। নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটিতে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটেছে। রাজশাহীর বাগমারায় কাদিয়ানি উপাসনালয়ে হামলা হয়েছে। দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির প্রাঙ্গণে যাত্রা প্যান্ডেলে বিস্ফোরণ ঘটেছে। দিনাজপুর ও রংপুরে যাজকের ওপর হামলা হয়েছে। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহে একজন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী নিহত হয়েছেন। এরপর ঘটল এই পুরোহিত হত্যাকা-ের ঘটনা। ঘটনাগুলোর প্রকৃতি ও ধারা দেখে প্রতীয়মান হতে পারে, কোনো অদৃশ্য শক্তি সুচিন্তিতভাবে দেশে সুদূর অতীত থেকে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। এ চেষ্টা দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষার স্বার্থেই রুখে দিতে হবে এবং রোখার কাজটি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকেই করতে হবে।
বিদেশী হত্যাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলার ঘটনায় সরকারী তরফের একটি সাধারণ বক্তব্য হলো, দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা দেশকে অস্থিতিশীল ও সরকার সরানোর জন্য এসব করছে। ঘটনার দায় দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারে না। সরকারের দায়িত্ব চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে এবং ধরে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা। এ পর্যন্ত অন্তত ১০-১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও তদন্ত শেষ হয়নি, সন্ত্রাসী গ্রেফতার ও শাস্তি তো আরও পরের কথা। বিস্ময়ের বিষয় হলো, ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। শত শত বছর ধরে এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয়-বর্ণীয় মানুষ শান্তি, প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে সঙ্গে বসবাস করছে। ভারতে যেখানে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে, পাকিস্তানে হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার অবস্থাও সুখকর নয়, সেখানে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অবিশ্বাস্য বলেই চিহ্নিত। গোটা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, খুন-খারাবি দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ বাংলাদেশ রয়েছে এর সম্পূর্ণ বাইরে। ভারতে মোদির শাসনে মুসলমান, খ্রিস্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষ নিত্যই নির্যাতিত হচ্ছে, কখনো বা খুন হচ্ছে। বাংলাদেশে তার এতটুকু প্রতিক্রিয়াও নেই। ভারতে মুসলমানেরা কতটা অবনত ও বঞ্চিত হয়ে আছে, সাচার কমিটির রিপোর্টে তার বিবরণ রয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের তিনটি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সার্বিক অবস্থার ওপর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে স্পষ্ট দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত। দলিতদের চেয়েও তাদের অবস্থা শোচনীয়। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের চেয়ে কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, এমন দাবি কেউ করতে পারবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বরং মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে আছে। শিক্ষা, সরকারী-বেসরকারী চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, মিডিয়াসহ নানা ক্ষেত্রে হিন্দুরা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান আরো সম্প্রসারিত ও দৃঢ় হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনে এবং আরো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মরত তাদের কিছু লোকের বাড়াবাড়ি প্রশ্নের সৃষ্টি করলেও এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক কোনো ক্ষোভ-অসন্তোষ নেই। এই অসম্প্রদায়িক মনোভাব, সহনশীলতা ও ঔদার্য এদেশের মুসলমানরা লাভ করেছে তাদের ধর্ম, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি থেকে।
বাংলাদেশের হিন্দুরাও ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপ্রিয় ও সদ্ভাবপ্রবণ। এখানে, বলাবাহুল্য, নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি। এরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলে হিন্দু-মুসলামানের মধ্যে কখনই উত্তেজনা, বিরোধ বা বিসংবাদ দেখা যায় না। সে রকম একটি এলাকায় হিন্দু পুরোহিতের ওপর হামলা অকল্পনীয় ব্যাপার। প্রকৃত কোনো মুসলমানের পক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। যারা এই হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা মুসলমান পরিচয়ের অনুপযুক্ত। আমরা জানি না, কারা এটা ঘটিয়েছে এবং তারা মুসলমান নাম-পরিচয়ধারী কিনা। তবে যারাই ঘটাক, তারা রেহাই পেতে পারে না। ঘটনা অনুপুঙ্খ তদন্ত করতে হবে। হামলা ও হত্যাকারীদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের হাওলায় তুলে দিতে হবে। যারা সাম্প্রদায়িক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়, দেশের মর্যাদা ক্ষুণœ করতে চায়, তারা দেশের মিত্র হতে পারে না। সুতরাং তারা কেউই যাতে কোনোভাবে ছাড় না পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ পর্যন্ত ওই ধরনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটির তদন্ত দ্রুতায়িত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে হবে এবং ঘাতক-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আমরা এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই
আরও পড়ুন