হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এই দেশের একটি গর্বের বিষয়। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদভা-ার আমাদের দেশকে বারবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে বহির্দেশের মানুষের কাছে। বিচিত্র এ দেশের প্রাকৃতিক শোভা, বিচিত্র তার অধিবাসীরাও। জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির এক মিশ্ররূপ আমাদের দেশ। বিবিধের মাঝে ও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্যবোধ, সবার জন্য কল্যাণ কাজে, দেশের গণতান্ত্রিক ভিতকে সুদৃঢ় করার কাজে বদ্ধপরিকর আমাদের দেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বারবার বলা হয়েছে, আমাদের দেশে ক’বছরের মধ্যে প্রারম্ভিক শিক্ষা সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হবে। সর্বজনীন প্রারম্ভিক শিক্ষার লক্ষ্য পূরণের জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। তার মধ্যে রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানামুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। গত পয়লা জানুয়ারি সারাদেশে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ৩৬ কোটি ১২ লাখ ৮২ হাজার বই প্রদান করা হয়েছে। দিবসটি ছিল যেন একটা আনন্দ উৎসবের দিন। এ উপলক্ষে শিক্ষমন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয়ে নিজেকে ধ্বংস ও সমাজ সভ্যতার ধ্বংস ছাড়া কিছুই করা যায় না। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, কল্যাণের ধর্ম। জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয়ে শুধু নিজেকে নয়, মহান এই ধর্মকে বিতর্কিত করা হয়েছে। ¯েœহ, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার হাতছানি থেকে দূরে রাখতে হবে। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম মেধার দিক থেকে দরিদ্র নয়। তারা একদিন বিশ্ব জয় করবে। শুধু মানসম্মত শিক্ষা দিলেই হবে না, আমরা সততা, ন্যায়নিষ্ঠ, শ্রদ্ধাশীল ও পরিপূর্ণ ভালো মানুষ চাই।
নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি বিকল্প বা পরিপূরক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। দেশব্যাপী উন্নতমানের শিক্ষার সুযোগ ও প্রসার ঘটাতে বিভিন্ন সময় শিক্ষা দফতরের মাধ্যমে যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার তা প্রশংসার দাবি রাখে। পরিমাণগতভাবে গোড়ার দিকে সাফল্য এলেও যে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা নিয়ে শিক্ষা দফতর এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে চৈনিক দেয়ালস্বরূপ বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যালয়-ছুটদের সমস্যা। বর্তমান বিদ্যালয়-ছুটদের সমস্যা দফতরের কাছে তথা সরকারের কাছে বিশাল একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য তাদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নকালীন আহার, পোশাক, অবৈতনিক শিক্ষা, বিভিন্ন বৃত্তি, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য নানা সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প, ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে শিক্ষামূলক ভ্রমণ, মেয়েদের জন্য সেল্ফ ডিফেন্স ট্রেনিং ইত্যাদি আরও কত কী। এত কিছুর পরও আমরা কেন আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না, তা খুব ভাবনার বিষয়। কারণ শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় পর্যন্ত যাচ্ছে না বলে বিদ্যালয়কেই শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়াÑ এ এক অভিনব প্রয়াস। কিন্তু তার পরেও পাওয়া যাচ্ছে না আশাপ্রদ ফল। এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য দফতর বিভিন্ন কমিটিও গঠন করেছে। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তা এখানে তুলে ধরলাম অন্যদের সঙ্গে মত বিনিময় করার জন্য।
বিদ্যালয় বললেই আমাদের মনের আয়নায় যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, স্কুলবাড়ি, শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষিকা, পাঠদান, পরীক্ষা ইত্যাদি। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়া মানে প্রথম দিন থেকেই পাঠ্যবই হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, এটা বড় বেশি নিয়মতান্ত্রিক। নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে শিশুমন বা বড়রাও হাঁপিয়ে ওঠে। সন্ধ্যাবেলা বাতি জ্বালানোর জন্য যেমন সলতে পাকানো, ঠিক তেমনি বিশেষভাবে প্রথম পর্যায়ের যারা ছাত্র, সে প্রথম শ্রেণিই হোক বা ষষ্ঠ শ্রেণি, তাদের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাই নিবিড়, আত্মিক সম্পর্ক। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। বিদ্যালয়-ছুটদের সমস্যা যেখানে বেশি, মানে গ্রামাঞ্চল বা শহরতলিতে, সেখানে এই সম্পর্কের ব্যবধানও অতি প্রকট। আমাদের যারা শিক্ষকতা করেন, তারা সবাই কি বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলতে পারেন যে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার? অল্প কিছু সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বাদ দিলে বেশির ভাগের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের দূরত্ব রয়েছে। সেখানে কাজ করে ভয়, ভীতি, অনাবশ্যক দুশ্চিন্তা যার ফলে শ্রেণিকক্ষে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। গণিতে ছাত্রদের করুণ অবস্থার কারণ নির্ণয় করার জন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে গণিতের প্রতি ভয়ই তাদের অনগ্রসরতার মূল কারণ।
শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক গঠনের জন্য কোনো কর্মসূচির কথা আমরা ভাবতে পারি কি? এমন কোনো কর্মসূচি নিলে হয় না? এটা কিন্তু খুব জরুরি। ভয়মুক্ত পরিবেশে যদি তাদের না ফেলা যায়, তাহলে শিক্ষার সুফল থেকে তারা তথা দেশ বঞ্চিত হবে। সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো আমার মতে প্রথম পদক্ষেপ। আদর, ভালোবাসার উষ্ণতায় তাদেরকে মাতৃক্রোড়ের সুরক্ষা প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন।
সর্বশিক্ষা মিশনের লক্ষ্য অনুযায়ী সবার জন্য ভর্তি নিশ্চিত করা হলো। কিন্তু ভর্তি করিয়েই ক্ষান্ত থাকা যায় না। তাদেরকে ধরে রাখাও একটি বিশেষ কাজ। তার জন্য শ্রেণিকক্ষের পাঠদান হওয়া চাই খুব আগ্রহ সৃষ্টিকারী এবং তা দেওয়া হোক নতুনত্বের মোড়কে। প্রথমেই বই থেকে পড়া না ধরে প্রথম শ্রেণির বাচ্চাদের নানা রকম ছড়া শেখানো যায়। সুন্দর সুন্দর গল্প বলে তাদের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি ভাব জমানো যায়, তার সঙ্গে যদি থাকে আদর আর দরদের মিশ্রণ, তাহলে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে আসতে চাইবে না, তা কি বিশ্বাস করা যায়? অনেককেই বলতে শুনি, ছাত্ররা কাজে চলে যায় বলেই বিদ্যালয়ে আসে না। আরে সেটা তো একটু বড়দের ক্ষেত্রে। সেই বড় ছাত্রগুলো যদি একদম প্রথম শ্রেণিতেই আগ্রহ উদ্দীপক পরিবেশ পায় এবং সেই পরিবেশের ওপর গড়ে ওঠে দ্বিতীয় শ্রেণির ভিত, তারপর এভাবে তৃতীয়, চতুর্থ ইত্যাদি তাহলে তারাই বিদ্যালয়ে আসার জন্য বায়না করবে। তাদেরকে বাড়িতে ধরে রাখাই যাবে না। সবাই যে শুধু আর্থিক কারণেই বিদ্যালয় ছুট হয়, তা কিন্তু নয়। সব বিদ্যালয়ের পরিবেশ ছাত্রদের অনুকূল, সেটা জোর গলায় বলা যায় না। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সমস্যা বহুবিধ। তারা নিজেরাই নানা রকম মানসিক ক্ষুদ্রতার শিকার হয় এবং তারাই বেশি করে বিদ্যালয়-ছুট হয়। ঘরেও তারা শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ পায় না। সেরকম ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের কাছে অনুরূপ বার্তা পৌঁছাতে হবে যাতে তারা অনুভব করতে পারে যে, বিদ্যালয় তাদের নানা সমস্যা সমাধানে হাত বাড়িয়ে দেবে, বিদ্যালয় তাদের কথা ভাবে।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকেও তাদের নির্দিষ্ট কাজগুলো সূচারুভাবে সম্পাদন করতে হবে। অনেককে বলতে শোনা যায়, তারা মিটিংয়ে আসেন না বা অভিভাবকদের ডাকলেও তারা আসতে চান না। তারা আসেন না ঠিকই কিন্তু তাদের সন্তানরা পরীক্ষায় অসফল হলে নানা রকম ঝামেলার সৃষ্টি করেন তারাই। তারা যদি নিয়মিত বিদ্যালয়ের মিটিংগুলোতে আসতেন, তাহলে হয়তো সমস্যা এড়ানো যেত। কিন্তু অভিভাবকদের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে মিশলে বোঝা যায়, পিতামাতা বা অভিভাবকদেরও আছে বিদ্যালয় সম্পর্কে ভীতি, আছে নানা রকম কুণ্ঠাবোধ, হীনম্মন্যতাবোধ। প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার উচিত নিজেদের আত্মগৌরব ভুলে গিয়ে সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের পিতামাতা, অভিভাবকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। বিদ্যালয়ের প্রতি বিকর্ষণের জায়গায় আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে চাই সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির স্ফূরণ ঘটানো। সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির সে কী অসীম ক্ষমতা রয়েছে তা শিক্ষক মাত্রই স্বীকার করবেন। শিক্ষাবিদ ওসমান গণীর যে বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘ Education is the mantifestation of perfection already in man’ শিশুর ভিতরের অন্তর্নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং একে রূপ দিতে গেলে তার ভিতরের প্রতিভাকে টেনে বের করতে গেলে একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলি। একটি বীজ বপন করলে তার চারাগাছে রূপান্তর থেকে শুরু করে মহীরুহ হয়ে ওঠা পর্যন্ত যে বিষয়গুলো অত্যাবশ্যক, সেগুলো হলো পানি, উপযুক্ত মাটি, বাতাস, পরিচর্যা ইত্যাদি। আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোকেও হজম করে জ্ঞানে সঞ্চারিত করতে গেলে চাই সেরকম পরিচর্যা, যা সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির দ্বারা সম্পন্ন হবে। শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলাপরায়ণতা, সহনশীলতা, নীতিবোধ, দায়বদ্ধতা, তার দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ণ শুধু পরীক্ষার পড়া শেখা আর খাতায় তা উগড়ে দেওয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় না। এর জন্য চাই দীর্ঘ অনুশীলন। সবার সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে বা মেয়ে যখন কোনো একটি গান গাইবে, বক্তৃতা বা আবৃত্তি করবে, সবার প্রশংসায় তা অপার্থিব আনন্দ নিয়ে তার কাছে ধরা দেবে। শ্রেণিকক্ষে যে ছাত্র বা ছাত্রী পিছিয়ে রয়েছে, তাকে সবার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে তাকে দিয়ে কিছু করালে তা জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, হাজার দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেমেয়েরা আদর ভালোবাসার কাছেই হার মানে, শাস্তি দিয়ে যেটা কোনো দিনই সম্ভব নয়। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা ভালোভাবে বজায় রেখেও করা যায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। সকালবেলায় সম্মেলনকে যদি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা যায়, সুদূরপ্রসারী ফল ফলতে পারে।
ছোট্ট ছোট্ট অনুষ্ঠান, যেমন এক ঘণ্টার একটা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের আয়োজন কখনো করা হলো, আবার কখনো কুইজ বা ছোট্ট কোনো নাটক, বড় ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আকস্মিক বক্তৃতা এসবের মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরি করার অনন্য নজিরের অভাব নেই। বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে গেলে ছাত্রছাত্রীদের যে কোনো কাজ, সেটা ছোটই হোক অথবা বড়, সে কাজকে প্রশংসা করা উচিত। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে একটা স্বীকৃতি পাওয়া, তাদের প্রশংসা, আদর একটা শিশুমনে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে, তা শৈশবের স্মৃতি যাদের কাছে এখনও অম্লান হয়ে আছে, তারা তা অস্বীকার করতে পারবেন না। বিদ্যালয়টা যদি সত্যি অর্থেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়, যদি শিশুরা সেখানে আনন্দ পায়, পায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অফুরন্ত অক্সিজেন, তাহলে তারা স্কুলছুট হবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। দারিদ্র্য শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, যদি আমরা এগুলো অনুসরণ করি।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পদ্ধতির মধ্যেও আনা চাই ব্যাপক পরিবর্তন। অঙ্কের কথাই ধরা যাক না কেন। অংক বিষয়টির প্রতি প্রথমেই দরকার অহেতুক ভয় দূর করা। সেটা না করে প্রথমেই যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, লসাগু, গসাগু, গুণিতক, গুণনীয়ক ইত্যাদি কতগুলো শব্দ শুনিয়ে এমনভাবে ভারাক্রান্ত করি। অঙ্কের ব্যাপারে প্রথমেই দরকার আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে, বাস্তবের নিরিখে তাদের সেটা বোঝানো। সংখ্যার সঙ্গে সংখ্যা মিললে বেড়ে যায়, সরিয়ে নিয়ে গেলে কমে যায়, সেটা অগণিত উদাহরণের সাহায্যে, দৈনন্দিন জীবনে যেগুলো সব সময়ই প্রযোজ্য, সেগুলো নিয়ে যদি অঙ্কের ধারণার ভিত তৈরি করা যায়, তাহলে অঙ্ক বিষয়টা অনেকের কাছে সহজবোধ্য হবে। আসলে শিশুদের অঙ্ক শেখানোর সময় প্রথম থেকেই একটা বিমূর্ত চিন্তাধারার মাধ্যমে সেটা শুরু করা হয়। আর সেখানেই লাগে বিপত্তি। অথচ দিন শুরু হওয়ার পর থেকেই আমাদের কিন্তু অংকের হিসাব শুরু হয়ে যায়। সময়, পরিমাণ, দূরত্ব, টাকা-পয়সা সংক্রান্ত অংক প্রতিদিনকার উদাহরণ থেকে বোঝালে সেটা বোধগম্যও হয় তাড়াতাড়ি এবং মনে থাকবে চিরদিন। কারণ শিক্ষাসহায়ক উপকরণের মধ্যে দৃশ্যমান উপকরণ এর ক্ষমতা অত্যধিক তা পড়–য়াদের একেবারে অস্থিমজ্জার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ডালপালা বিস্তার করে। তবে একটা বিষয় অতীব প্রয়োজনীয়। চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতেই ছাত্র-ছাত্রীদের ২০ পর্যন্ত নামতা শিখানো দরকার, যা অংক করতে বা চলার পথে খুবই কাজে লাগে।
ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে তাই। বিভিন্ন শব্দ চেনাবার সময় আমাদের হাতের কাছে, শ্রেণিকক্ষের ভিতরেই অনেক জিনিস আছে, যেগুলোর নাম শেখাতে বাংলা ভাষার দরকার হয় না। চেয়ার, টেবিল, বুক, চক, ডাস্টার, ব্লাকবোর্ড রুম, রুফ, স্টুডেন্ট, চার্ট, পেন, পেনসিল ইত্যাদি অনেক শব্দ আমরা ঘরে বসেই পেয়ে যাই। নাউন বা বিশেষ্য এভাবে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও প্লেগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে অজ¯্র শব্দ আছে যা চিনতে কোনো অসুবিধাই হয় না। অ্যাডজেকটিভ শেখাতে গিয়ে এই শ্রেণিকক্ষের টল/শর্ট, হাই/লো, এবাভ/আন্ডার, ব্লাক/হোয়াইট, লং/শট, ক্লিন/ডার্টি ইত্যাদি অনেক শব্দ শিখিয়ে ফেলা যায় একদম বিনা আয়াশে। সহপাঠীদের সামনে একজন ছাত্র এবং একজন ছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে, যাদের মধ্যে একজন বেঁটে এবং একজন লম্বা এমন দুজনকে বয়/গার্ল, টল/শর্ট চেনানোই যায়। বিদ্যালয়ের কাছের এবং দূরের কোনো জায়গার উদাহরণ দিয়ে নিয়ার এবং ডিস্ট্যান্ট শব্দ বোঝাতে পারি। এভাবে ইংরেজিতেও পরিচিত জায়গা থেকে তাদের অপরিচিতের দিকে, জানা থেকে অজানায়, সহজ থেকে কঠিন এবং মূর্ত এবং বিমূর্তর নিয়ে গেলে শেখাটা কতই না আনন্দদায়ক হয়।
আমাদের নেই অনেক কিছু, কিন্তু আছে বিশাল হৃদয়। হৃদয়ের অবাধ, অনন্ত, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, নব নব উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে শিশুদের শেখার জগৎটাকে করে তুলতে পারি বৈচিত্র্যময়, বর্ণময়। উৎসাহসঞ্চার, প্রশংসা, আগ্রহ আর অভিনবত্বের মেলবন্ধনে, ভালোবাসা আর আদরের গভীর বন্ধনে যদি আমরা পড়–য়াদের ক্রোড়ে তুলে নিতে পারি, তাহলে বিদ্যালয়-ছুটদের সমস্যা তলানিতে এসে ঠেকবে, এ কথা হলফ করেই বলা যায়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।