Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

গড়ে উঠছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গ্রুপ

রাজধানীতে কিশোরদের হাতে হাতে অবৈধ অস্ত্র

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে কিশোরদের হাতে হাতে অবৈধ অস্ত্র। নানা নামে ও গ্রুপে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্রুপ। উঠতি বয়সের তরুণদের পাশাপাশি ১০-১২ বছরের শিশুদের হাতে এখন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে অবৈধ অস্ত্র। আর এসব অস্ত্রের ছড়াছড়ি এখন রাজধানীর পাড়া-মহল্লা থেকে অলি-গলিতে। অস্ত্র সহজলভ্য হওয়াতে দিন দিন কিশোর গ্রুপের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পিতা-মাতা কিংবা স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও এদের ভয়ে তটস্থ থাকেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, অনেক নামী-দামি স্কুল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয় না। নেই যথাযথ পাঠদান। রয়েছে মনিটরিংয়ের অভাব। তারা শুধু কোচিং বাণিজ্যেই ব্যস্ত রয়েছেন। ফলে কিশোর-কিশোরীরা দিন দিন বিপথগামী হচ্ছে। তারা বলছেন, রাজধানীর অনেক এলাকাতে গড়ে ওঠে কিশোরদের এমন কিছু গ্রুপ, যাকে বলা হয় ‘গ্যাং’। এসব গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যই নামকরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের প্রায় সবার বয়সই ১৮ বছরের নিচে। এই গ্যাংয়ের মধ্যে মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন, মাদক গ্রহণ, নিজেদের ভাগাভাগি করে নেয়া এলাকায় ‘শোডাউন’  লেগেই আছে। সবাই সব জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। এখন  তো প্রতিটা গ্রুপের ফেসবুক পেজও আছে। সেখানে পরস্পরকে হুমকি দেয়া, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করা নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি এদের প্রায় সবার ফেসবুক প্রোফাইলে অদ্ভুত ডাকনামও  দেয়া থাকে। যেমন কারো কারো নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে ‘নবাব’, ‘হিটলার’, ‘বয়রা’, ‘ইবলিশ’ প্রভৃতি। গ্রুপের ভেতর এসব নাম ধরেই ডাকা হয় তাদের। এদের ফেসবুক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত  প্রোফাইল স্ট্যাটাসে ইমো হিসেবে বোমা, পিস্তল, সিগারেট ব্যবহার করতে দেখা যায়। এছাড়া এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে গালি দিয়ে তাদের এলাকায় প্রবেশ করলে ‘দেখে নেয়ার’ প্রকাশ্য হুমকি  দেয়।
সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের ৭৫৯ উঠতি সন্ত্রাসীর তালিকা  তৈরি করেছে। তবে ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছেÑ এ তালিকার মধ্যে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরের সংখ্যাও শতাধিক। যাদের হাতে রয়েছে নামী-দামি অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, মূলত অভিভাবকদের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই এসব শিক্ষার্থীর সম্ভাব্য সোনালি জীবন এক রকম অন্ধকার জগতে ডুবে  যেতে বসেছে।
মহানগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে অস্ত্র রয়েছে। এলাকার কথিত বড় ভাইদের ক্রীড়নক হিসেবে এরা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাগি ও বিভিন্ন মামলার পলাতক সন্ত্রাসীদের  নির্দেশনা অনুযায়ী এরা চাঁদাবাজি ছাড়াও নানারকম সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয়। আবার কোনো কানেকশন না থাকলেও সহজে চাঁদার টাকা পাওয়ার জন্য এদের কেউ কেউ বড় বড় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে চলে। ওদিকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারি দলের বড় ভাইদের বিভিন্ন স্বার্থের কাজে হর-হামেশা ব্যবহৃত হয়। তাই এ চক্রের কোনো  কোনো গ্রুপ বড় ভাইদের ক্যাডার বাহিনী হিসেবেও পাড়া-মহল্লায় পরিচিতি লাভ করেছে। যে কারণে পুলিশের খাতায় নাম থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এদের আটক করার সাহস পায় না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজধানীর উত্তরায় উঠতি কিশোর-তরুণরা মিলে গড়ে তুলছে ভয়ঙ্কর বখাটে গ্রুপ। এলাকায়  মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতা, গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ডান্স পার্টি, ক্লাবের আড্ডাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া ওই সব গ্রুপ। এলাকার আতঙ্ক হয়ে ওঠা এই গ্রুপ দু’টির একটির নাম ‘ডিসকো গ্রুপ’, অন্যটি ‘নাইনস্টার গ্রুপ’। লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে বখাটেপনায় মেতে ওঠা এই উঠতি তরুণদের মধ্যে এখন এলাকার আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে।  
উত্তরায় বিভিন্ন নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলে লেখাপড়ার পরিবর্তে শিক্ষকরা ছেলেদের সাথে অত্যধিক ‘ফ্রেন্ডশিপ’ করে শুধু কোচিং ব্যাণিজ্যেই ব্যস্ত থাকেন। লেখাপড়া কিংবা কোনো ধরনের নৈতিক শিক্ষা প্রদান তো দূরের কথা অনেক সময় তাদের অনৈতিক কাজেও সমর্থন দিয়ে থাকেন কিছু শিক্ষক। ছেলেদের লেখাপড়ার চেয়ে যে কোনোভাবে কোচিং করানো আর মাসে মাসে অভিভাবকদের কাছ থেকে বছর বছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াই কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এলাকাবাসী বলছেন, উত্তরায় ঢাকা মেগাসিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মাইলস্টোন কলেজে শিক্ষার নামে চলছে বাণিজ্য। একই অভিযোগ রয়েছে  স্কুল কর্তৃপক্ষ ও কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে।
রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের সন্তানরাও পা বাড়াচ্ছে এ অন্ধকার জগতে। তাদের অনেকে মাদকাসক্তও হয়ে পড়ছে। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়ছে নৃশংস খুনোখুনিতে। মূল্যবোধহীন এক সমাজে বেড়ে ওঠা এসব কিশোর ক্রমেই যেমন অস্থির হয়ে উঠছে, তেমনি পরিবারের অজান্তেই হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলামও সম্প্রতি এসব উঠতি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা  বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ  দেখে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। তিনি জানান, এসব ভিডিও ফুটেজে উঠতি কিংবা কিশোর বয়সের সন্ত্রাসীদের দেখা গেছে। এছাড়া অস্ত্রসহ গ্রেফতারকৃত কয়েকজন কিশোর সন্ত্রাসীর জবানবন্দিতেও উঠতি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়।
গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সন্ত্রাসীরা এসব অস্ত্র সংগ্রহ করছে সীমান্ত এলাকার অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ৭৫টি গ্রুপ বিভিন্ন কৌশলে সীমান্ত এলাকা থেকে এসব অস্ত্র রাজধানীর উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার কারাগারে আটক ও বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মজুদের একটি অংশ এসব উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে।
এদিকে এসব উঠতি সন্ত্রাসীদের অপরাধের পেছনে অন্যতম কী ধরনের কারণ কাজ করছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তাদের পর্যবেক্ষণে এখন পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত, চাঁদাবাজি। আধিপত্য বিস্তার, এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, মাদক ও ঝুট ব্যবসার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং বেশ কিছু ঘটনায় পরকীয়াসহ নারীঘটিত বিভিন্ন কারণও বেরিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার বন্ধে বিজিবির মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। তবে সেভাবে তাদের তৎপরতা চোখে পড়ে না।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, দেশে আনুমানিক ৩ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন পর্যায়ের সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একশ্রেণীর নেতাকর্মীর হাতে আছে। সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে বড় ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রও। এগুলোর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ ব্যবহার করে থাকে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা, ৩০ ভাগ অস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীরা। প্রায় ১০ ভাগ অস্ত্র চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধের কাজে ব্যবহার করছে।
প্রায় ১০ হাজার পেশাদার সন্ত্রাসীর হাতে লাইসেন্স করা অত্যাধুনিক ৯ এমএম পিস্তল রয়েছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছেন। তবে প্রতিদিন কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের পরিমাণের সঠিক কোনো হালনাগাদ তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে নেই। তাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকাও নেই।  গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারাদেশে আড়াই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী রয়েছে।



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৮ পিএম says : 0
    আমি ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক বাহাউদ্দিন সাহেবকে সুন্দরভাবে একটা তথ্য বহুল সংবাদ আমাদেরকে পরিবেশন করার জন্য আমার আন্তরিক মোবারকবাদ ও তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। এখনে পুলিশের কথাও এসেছে আমি অবাক হয়ে যাই পুলিশ এসব সন্ত্রাসের বিস্তারিত খবর জানার পরও কিভাবে সন্ত্রাসী কর্যক্রম এরা চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে পুলেশের নামে যে বদনাম আছে তারা সন্ত্রাসীদের সাথে একাত্য হয়ে পকেট ব্যাবসা করে থাকে এই অপবাদটা কি তাহলে সত্য??? আইন প্রতিরক্ষা বাহিনীর যদি এভাবে অধপতন হতে থাকে তাহলে দেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পরবে এটাই সত্য। তাই আমি আবারও মুক্তিযোদ্ধা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল সাহেবকে বলতে চাই এখনও কিছু সময় বাকী এরই মধ্যে যদি আপনি শক্ত হাতে আপনার বাহিনীর রশি ধরতে না পারেন তাহলে সামনে সবসহ তলীয়ে যাবার ভয় আছে। আমি সাথে সাথে জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে চাই সময় এখনও চলে যায়নি আপনার মন্ত্রীর লাগাম টেনে ধরুন তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে নয়ত বিপদ অনিবার্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাসী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ