পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে মালয়েশিয়া সরকার। এর ফলে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। এটি বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে এক ধরনের অশনিসংকেতও বটে। মালয়েশিয়া শুধু বিদেশী শ্রমিক নেয়া স্থগিতই করেনি, দেশটিতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ অভিবাসীকর্মীদের আটক করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে। নিজ বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশী রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ৮২ হাজার ২৮৭ জন শ্রমিক বৈধ। বলাবাহুল্য, এমওইউ স্বাক্ষরের পর এদের মধ্যে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। দেশেও মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও স্বপ্ন পূরণের সহজ দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাপক সাফল্যের কথাও প্রচার করা হয়। চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের স্বপ্ন তো ভঙ্গ হলোই, সরকারের সাফল্যের প্রচারণাও আশার ফানুসে পরিণত হলো। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে নতুন করে কর্মী নেয়ার ব্যাপারে জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সব আশা-দূরাশায় পর্যবসিত হয়েছে। গত শুক্রবার পূর্ব মালয়েশিয়ার কোতাকিনাবালু মোয়ারা তুয়াং আর্মি ক্যাম্পে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো শ্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদী অভিবাসীকর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিতের ঘোষণা দেন। এতে আগামী তিন বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাওয়ার যে সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বায়রার সভাপতি আবুল বাসার সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ার এ ঘোষণাকে ‘বাচ্চা জন্মের আগেই হত্যার’ শামিল বলে মন্তব্য করেছেন।
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বাজার সংকুচিত হয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া এক প্রকার বন্ধই করে দিয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে সাড়া পাওয়া যায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় ২০০৯ সালের মার্চ থেকে শ্রমিক রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক উদ্যোগের পর ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুধু প্লানটেশন খাতে জিটুজি প্রক্রিয়ায় কর্মী নিয়েগের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়। এ নিয়ে সেসময় সরকার এমনই ঢাকঢোল পেটাতে থাকে যে, যেন মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশী শ্রমিকরা দলে দলে সেখানে যেতে পারবে। সারাদেশ থেকে দুই দফায় ২২ লাখ কর্মীর নিবন্ধন কার্যক্রমও সম্পন্ন করে। বাস্তবে দেখা গেল, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে এ বছরের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৯ হাজার ৮৯২ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সরকারের ঘোষণা ও প্রচার যে আষাঢ়ে তর্জন-গর্জন ছিল তা উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে বুঝতে বাকি থাকে না। গত বৃহস্পতিবারও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর এমন প্রচারণা চালানো হয় যে, এবার আর পূর্বের চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে না। তিন বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া যাবে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা দেখা যায়। অথচ সরকারের তরফ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার বিষয়টিতেও শুভঙ্করের ফাঁকি লুকিয়ে ছিল। এ ফাঁকি প্রকাশ করে দিয়েছে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা স্বয়ং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম। তিনি গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে তিন বছরে ১৫ লাখ কর্মী নিচ্ছে না মালয়েশিয়া। এ খবর সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন করা শ্রমিকের সংখ্যা যারা বিশ্বাব্যাপী ১৩৯টি দেশে কাজ খুঁজছে। এই তালিকার প্রথমদিকে আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনা হবে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা নিয়েও এক ধরনের প্রতারণামূলক প্রচারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে জনগণের সামনে এ ধরনের প্রতারণামূলক প্রচারণা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। এতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের মধ্যে বিশেষ করে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের মধ্যে প্রভুত আশার সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে যা হতো, তা হচ্ছে, গমনেচ্ছুদের অনেকে জীবনের শেষ সম্বল জমি-জমা, ভিটা-মাটি বিক্রি করার উদ্যোগ নিত এবং তারা প্রতারক দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হতো। এর দায় কি সরকার তখন নিত? চুক্তি স্থগিত হওয়ায়, সরকারের প্রচারণার অসত্য দিকটি উন্মোচিত হয়েছে। সরকারের প্রচারণা যে ‘তিলকে তাল করার মতো’ তা জনসাধারণ বুঝতে পেরেছে। স্থগিত না হলে, সরকার নিশ্চিতভাবেই ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া যাচ্ছে বলে ক্রমাগত প্রচারণা চালাতো। এ ধরনের ক্রেডিট নেয়া কখনোই নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়তে পারে না। কোনো সরকারের কাছ থেকে জনগণ তা আশাও করে না।
বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়া নিয়ে অতি উল্লসিত ও ক্রেডিট নেয়ার কিছু নেই। এটি শ্রমশক্তি রফতানিকারক দেশের কাছে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে হইচই করা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে এক দশক আগে এ নিয়ে হইচই হতে দেখা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই জনশক্তি রফতানি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়িত হবে কি হবে না, তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই সরকারের তরফ থেকে এমনভাবে প্রচার-প্রচারণা শুরু করা হয়, যেন সোনার খনি পেয়ে গেছে। অথচ একজন শ্রমিক পাঠানোর আগেই এমন প্রচারণা যে দুর্বল সরকারের লক্ষণ, তা একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার আগেই এ ধরনের প্রচারণা কাম্য হতে পারে না। মালয়েশিয়ার সাথে সর্বশেষ এমওইউ স্বাক্ষর স্থগিত হওয়া নিশ্চিতভাবেই বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যান্য জনশক্তি রফতানিকারক দেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।