পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাজধানী ঢাকা বসবাসের অযোগ্য এবং অসভ্য নগরীতে পরিণত হওয়ার কথা নতুন নয়। অন্তহীন সমস্যার নগরী এটি। বিশ্বে এমন নগরী খুঁজে পাওয়া ভার। কী করে একটি দেশের রাজধানী এত অপরিকল্পিত এবং অবাসযোগ্য হতে পারে, তা বিশ্বের কাছে বিস্ময় হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে এটি একটি বিস্ময়কর গবেষণার ক্ষেত্র। তাদের গবেষণারও অন্ত নেই। কিছুকাল পর পর গবেষণা করে অবাক হওয়ার মতো তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরছে। আমরা দেখছি, শুনছি, তারপর তা ভুলে যাচ্ছি। এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যায় না। ফলে পুরো রাজধানী ঢাকার একটি সমস্যার আঁটি হয়ে আছে। রাজধানীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এবং একে বাসযোগ্য ও সুসভ্য করে তোলার জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার, এর সেবায় নিয়োজিত কোনো কর্তৃপক্ষের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমন চলছে চলুক। এভাবে কোনো দেশের রাজধানী যে চলতে পারে না এবং চলতে দেয়া উচিত নয়। এ নগরীতে এমন কোনো সমস্যা নেই যা, খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাধারণত রাজধানীর নাগরিকরা সবচেয়ে সুসভ্য ও উন্নত সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে থাকেন। তাদের জীবনযাত্রা এবং চলাফেরায় সভ্যতার লক্ষণ ফুটে উঠে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও নগরীর সেবায় নিরন্তর কাজ করে যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাজধানীর চলমান চেহারা দেখলে এর কোনো কিছুই চোখে পড়ে না।
মানুষ অভ্যাসের দাস। যে কোনো ভালো বা খারাপ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। যারা ঢাকার বাসিন্দা, তারাও অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়েছে। একটি সুসভ্য নগরীর চরিত্র কেমন হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারে না। মাঝে মাঝে বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বিস্মিত হই এই ভেবেÑ এমন শহরও কি হতে পারে! যারা বিদেশ-বিভূঁই ঘুরে এসে সেসব দেশের রাজধানী বা অন্য কোনো শহরের গল্প করেন, তখন ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তা তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই শোনায়। অথচ এসব রূপকথা নয়, মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং পরিকল্পনারই ফসল। আমাদের রাজধানী কর্তৃপক্ষ এসব পরিকল্পনা যথাযথভাবে নিচ্ছে না বা করছে না বলে নিজেদের অসভ্য নগরীর বাসিন্দা হয়েই থাকতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতে সমস্যার কথা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। এখানে নাগরিক সেবা বলতে গেলে নেই। নাগরিকরা নিজেরাই যেভাবে পারে, সেবা খুঁজে নেয়। এতে পরিকল্পনা বলে কিছু থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর যে আয়তন এবং এখানে যে সংখ্যক লোকজন থাকা প্রয়োজন তার দ্বিগুণ-তিনগুণ লোক বসবাস করছে। সাধারণত যে শহরে এক কোটি লোক বসবাস করে, তাকে মেগাসিটি বলা হয়। সরকারি হিসেবেই ঢাকায় বসবাস করছে ১ কোটি ৭০ লাখ লোক। এর প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার লোক বসবাস করছে। মানুষ গাদাগাদি করে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থাকছে। তার উপর প্রতিদিন রাজধানীতে প্রবেশ করছে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ। আয়তনের তুলনায় বিশ্বে আর কোনো শহরে এমন নজির দেখা যায় না। আবার ঢাকার আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। একদিকে বাড়ছে তো বাড়ছেই। নগরীর সব বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। এটা কোনো রাজধানীর চরিত্র হতে পারে না। আমরা যদি ঢাকার দিকে তাকাই, দেখা যাবে, নিরাপদে চলাফেরা, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা প্রদান, আইন-শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাÑ এসবের পরিপূর্ণ সুবিধা এখানে নেই। ভাবা যায়, একটি আদর্শ শহরে চলাচলের জন্য যেখানে সড়ক থাকার কথা ২৫ ভাগ সেখানে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। এই স্বল্প রাস্তা আবার দখলসহ বিভিন্ন কারণে আরও কমে গেছে। এর উপর প্রতিদিন ৩০৩টি করে নতুন গাড়ি নামছে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন করুণ থেকে করুণতর দিকে ধাবিত হচ্ছে যে, যানজটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে দেখিয়েছে, এক যানজটে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার উপরে ক্ষতি হয়। প্রতিদিন ক্ষতি হয় ২২৮ কোটি টাকার মতো। মানুষের কর্মঘন্টা নষ্ট হয় বছরে ৮০ লাখ ঘন্টা। যানজটের এমনচিত্র বিশ্বে আর একটি রাজধানীতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে মানুষ ট্যাপ খুলে নিশ্চিন্তে এক গ্লাস নিরাপদ পানি খাবে তার কোনো সুযোগ নেই। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পানের অযোগ্যতো বটেই, তা দিয়ে রান্নাবান্না, গোসল করাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা, কীট পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ এই দূষিত পানিই নগরবাসীকে অতি উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি, গ্যাস পাওয়াও এখন কঠিন। শীত মৌসুম এলেই চুলা জ্বলে না, তীব্র সংকট দেখা দেয়। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় নগরবাসীর খানাখাদ্য রান্না করা বন্ধ হয়ে যায়। বিপরীতে তাদের গ্যাসের দাম ঠিকই দিতে হচ্ছে। এখানে জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা বিরাজমান। রাস্তা-ঘাট অবৈধভাবে দখল করা নিত্যকার বিষয়। অথচ বিশ্বে এমন রাজধানী খুব কমই রয়েছে যার চারপাশে বহমান নদী রয়েছে, শহরের ভেতর খাল ও ঝিল রয়েছে। প্রাকৃতিক সুরক্ষা সম্বোলিত এমন রাজধানী পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। অবৈধ দখলদাররা তার সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে নগরবাসী বুক ভরে নিঃশ্বাস যে নেবে এবং প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করবে, তার কোনো উপায় নেই। এখন এর অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে ঘন ঘন ভূমিকম্প দেখা দিচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে সরকারি হিসেবেই প্রায় ৭৩ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যদি তাই হয়, তবে রাজধানীর অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না।
রাজধানীর দুয়েকটি এলাকার সৌন্দর্য বর্ধন করে একে বসবাস উপযোগী করা যাবে না। এটা শুধু অন্ধকারে একটু আলো হয়েই থাকবে, পুরো অন্ধকার দূর হবে না। প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এলাকাভেদে ভাগে ভাগে উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে কিছুটা হলেও একে উপযোগী করে তোলা সম্ভব। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথ পরিকল্পনা করলে এবং এ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নিলে, ছোট জায়গাও বাসযোগ্য করে তোলা যায়। সবার আগে প্রয়োজন অপরিকল্পিত যেসব কার্যকলাপ চলছে, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। শহরের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। বৃদ্ধির বিষয়টিও পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নাগরিকরা যেসব সমস্যা মোকাবেলা করছে, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের সমন্বয় করতে হবে। অর্থ দেবে সুযোগ-সুবিধা পাবে না, এটা হতে পারে না। বলা বাহুল্য, রাজধানীর বেহালদশা ও বসবাসের অনুপযোগী রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও তা বিশ্বের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ একটি দেশের রাজধানীর সৌন্দর্য সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক হিসেবে কাজ করে। আমরা আশা করব, রাজধানীতে যেসব সমস্যা প্রকট হয়ে রয়েছে এবং যেসব অনাচার সংঘটিত হচ্ছে, সেগুলোর সমাধানে সরকার, সিটি করর্পোরেশন ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।