Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে পানি বিদ্যুতে স্বস্তি গ্যাস সঙ্কট যানজটে নাকাল

| প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে পানি বিদ্যুতে স্বস্তি আসলেও গ্যাস সঙ্কট আর যানজটে নাকাল হচ্ছে নগরবাসী। শীত শুরু হতেই গ্যাস সঙ্কট তীব্র হয়েছে। মহানগরীর অনেক এলাকায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রান্নার চুলা জ্বলছে না, উৎপাদনে ধস নেমেছে কল-কারখানায়। একাধিক ফ্লাইওভার চালু আর সড়ক সম্প্রসারণের পরও যানজটে স্থবির হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। অপরিকল্পিত নগরায়ন গিলে খাচ্ছে উন্নয়নের সুফল।
বিগত ২৯ বছর পর একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় নগরীতে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় ৩৪ কোটি লিটার ছাড়িয়ে গেছে। ওয়াসার হিসাবে নগরীতে পানির দৈনিক চাহিদা ৫০ কোটি লিটার হলেও এখন পানি সঙ্কট সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। আরও কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়াসা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ নগরীতে পানির আর কোন সঙ্কট থাকবে না বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ খাতেও এখন স্বস্তি বিরাজ করছে। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি খাতে ছোটবড় বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেছে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে কয়েকটি ইউনিট বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রামে চাহিদার সমান বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা এখন হাজার মেগাওয়াট। আর এই অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি সরবরাহ মিলছে। সঞ্চালন ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে কোন কোন এলাকায় নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, এখন লোডশেডিং আর নেই।
মহানগরীতে এক সময় রেশনিং করে পানি দেওয়া হতো। এখন সে অবস্থা নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণাও নেই। তবে গ্যাস সঙ্কট আর যানজটে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে নগরজীবন। শীতের শুরুতে তীব্রতর হয়েছে গ্যাস সঙ্কট। বহুজাতিক সার কারখানা কাফকোতে গ্যাস সরবরাহ শুরু করার পর সংকট আরো বেড়েছে। অনেক এলাকায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বন্ধ থাকছে চুলা। সিএনজি স্টেশনগুলোতে গাড়ির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।
চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান বাড়ানোর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠছে। চাহিদা এবং প্রাপ্তি বিশাল ব্যবধানে এখানে গ্যাসের জন্য হাহাকার চলছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রামে দৈনিক ৪শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। অথচ গত বেশ কিছুদিন ধরে গড়ে ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেয়া হচ্ছে। সাগরবক্ষের একমাত্র গ্যাস ক্ষেত্র সাঙ্গুর উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর থেকে এখানে গ্যাসের সংকট চরমে। গ্যাসের অভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না। বিদ্যমান কারখানাগুলোও নতুন ইউনিট চালু করতে পারছে না।
এতে করে বিনিয়োগ এবং সেই সাথে কর্মসংস্থানও থমকে আছে। রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে সারকারখানায় গ্যাস দেওয়া হয়। আবার সারখানা বন্ধ করে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।
এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবির পরও চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না।  বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস আনা হচ্ছে তার থেকে বেশি গ্যাস আনার অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। বিদ্যমান ২০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ দিয়ে এর চেয়ে বেশি গ্যাস আনা সম্ভব নয়। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস দিয়ে টিকে আছে চট্টগ্রামের জ্বালানি খাত। আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ পাইপলাইন দিয়েই চট্টগ্রামে গ্যাস আসছে। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের বিভিন্ন গ্যাসফিল্ডের উৎপাদিত গ্যাস সাতটি সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে ঢাকায় নেয়া হয়। তবে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয় একটি লাইন দিয়ে।
আশির দশকে নির্মিত আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ লাইনটি দিয়ে চট্টগ্রামের জন্য বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে জানান কর্মকর্তারা। আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন লাইনের পাশাপাশি নতুন একটি সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা গেলেই কেবল এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়। তবে এই সমস্যা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেই। ২০০৭ সাল থেকে বিকল্প লাইন বসানোর দাবি উঠে। তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এলএনজি (তরল গ্যাস) আমদানির তোড়জোড় শুরু হলেও কবে নাগাদ এ গ্যাস আসবে তাও অনিশ্চিত। সাম্প্রতিক সময়ে নগরীর আবাসিক খাতেও গ্যাসের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে। নগরীর খুলশী, নাসিরাবাদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর হাউজিং এস্টেট, মধ্যম হালিশহর, মনসুরাবাদ, ষোলশহর, বায়েজিদ, পাথরঘাটা, ঘাট ফরহাদবেগ, বাকলিয়া, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঘরে গ্যাসের হাহাকার।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। গত কয়েক বছরে নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তিনটি ফ্লাইওভার একটি ওভারপাস চালু হয়েছে। বেশ কয়েকটি সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন সড়কও। এরপরও যানজটে স্থবির হচ্ছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর ভিত্তিক এই মহানগরী। যানজটে আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন আর ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার কারণে যানজট দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে। জনবহুল এই মহানগরীতে নেই কোন কেন্দ্রীয় বাস ও ট্রাক টার্মিনাল। মহানগরীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের জন্য নেই কোন টার্মিনাল বা স্ট্যান্ড। নেই পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা। এতে করে যেখানে ফাকা জাগয়া সেখানে গড়ে উঠছে অবৈধ পার্কিং। একদিকে যানবাহনের ঢল, অন্যদিকে রাস্তা ফুটপাত দল-সবমিলে চরম বিশৃঙ্খলা নগরীতে।
অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে উন্নয়নের সুফল মিলছে না বলে মনে করে নগর পরিকল্পনাবিদেরা। কর্ণফুলী সেতু চালু হয়েছে বিগত ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। এখনও সংযোগ সড়কটি সম্প্রসারণ করা হয়নি। নগরীর বহদ্দারহাট থেকে সেতু পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজট হচ্ছে। সড়কটি একদিকে সরু অন্যদিকে ভাঙাচোরা। এতে করে ওই সেতুমুখী যানবাহন ওই সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে। এর প্রভাবে বহদ্দারহাট এলাকায়ও তীব্র যানজট হচ্ছে।
ওই সড়কটি সম্প্রসারণ না করায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে সেতুর জন্য আসা কুয়েত ফান্ডের টাকা দিয়ে সড়কটি সম্প্রসারণ করার কথা থাকলেও পরে ওই টাকা ফেরত গেছে। এর পর কয়েক দফা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। কদমতলী ফ্লাইওভার, দেওয়ানহাট ওভারপাসেও সড়ক দখল হয়ে যাওয়ায় তীব্র যানজট হচ্ছে। নতুন চালু হওয়া মেরিনার্স রোডের সুফল গিলে খাচ্ছে কোতোয়ালী, নিউমার্কেট ও আসাদগঞ্জের যানজটে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ