Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে সয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে দেশ

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উচ্চ ফলনশীল বীজ, ভালো সার ও জ্বালানি ভর্তুকি দিলে ৪ কোটি টন ফসল উৎপাদন সম্ভব
নাছিম উল আলম : উচ্চ ফলনশীল উন্নত বীজ এবং সুষ্ঠু বালাই ব্যবস্থাপনাসহ আবাদ প্রযুক্তি এবং মানসম্মত সার ও ন্যায্য মূল্যে জ্বালানি কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে দানাদার খাদ্য ফসলের উৎপাদন ৪ কোটি টনে পৌঁছতে পারে বলে দাবি কৃষি-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের, যা দেশকে খাদ্যে সয়ম্ভরতা এনে দেবে। দেশে গত বছর দানাদার খাদ্য ফসলের উৎপাদন ছিল প্রায়  ৩ কোটি ৬৫ লাখ টনের মতো। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে সরাসরি কৃষকের কাছে ভর্তুকিসহ আরো নিবিড় কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। এখনো দেশের মাত্র ২০ ভাগেরও কম জমিতে বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র ব্যবহৃত হলেও গত এক যুগ ধরে তাতে সরকার ২৫% ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ কৃষি-সেচ কাজে ব্যবহৃত ৮০ ভাগ সেচ পাম্পে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম গত এক যুগে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। সেচকাজে ব্যবহৃত ডিজেলে কোনো ভর্তুকিও নেই। গত বছর ডিজেলে লিটারপ্রতি ৩ টাকা দাম কমানো হলেও তা কার্যকর হয়েছে বোরো মওসুম শেষ হবার পর। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গত বছর দেশে বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, এখনো আমাদের দেশে ধান উৎপাদনে ২৮% সেচ ব্যয়, যা উপমহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ ভিয়েতনামে তা মাত্র ৬%, থাইল্যান্ডে ৮% ও ভারতের মরুপ্রবণ পাঞ্জাবে ১৩%। এরপরও আমাদের দেশে ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৪.২ টন, যা চীন, জাপান ও কোরিয়াতে ৬ টন থেকে সাড়ে ৬ টন পর্যন্ত। এমনকি গত প্রায় সাড়ে ৪ দশকে দেশে ধানের জমির পরিমাণ প্রায় ১৮% হ্রাস পাবার পরও চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩.২০ গুণ।  
কৃষি সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, দেশে ১৯৫০-৫১ সালে সর্বমোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬২ লাখ টন। সে সময় বীজ ও সব ধরনের অপচয় বাদে চালের নিট প্রাপ্তি ছিল ৫৬ লাখ টনের কাছাকাছি। ৪ কোটি ২১ লাখ জনসংখ্যার দৈনিক মাথাপিছু ৪৫৪ গ্রাম হিসেবে তখন খাদ্যশস্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন। ১৯৬৮ সালে দেশে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-‘ইরি’ উদ্ভাবিত উফশী জাতের ধানের আবাদ শুরু হয়। ফলে ১৯৭৫ সালে দেশে চালের উৎপাদন ১ কোটি সাত লাখ টনে উন্নীত হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার টনে, যার মধ্যে ঐ সময়ে আমন ধান থেকে চালের প্রাপ্তি ছিল প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টনের মতো।
চলতি মওসুমে আমন থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টন চাল প্রাপ্তির পর ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরা আবাদের লক্ষ্যে বীজতলা তৈরি শুরু করছেন কৃষকরা, যা থেকে আরো ১ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি আউশ ধান থেকেও আরো প্রায় ২২ লাখ টন চাল পাওয়া গেছে। এর বাইরেও দেশে এখন প্রায় ১৫ লাখ টন গম উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে দেশে এখন চাল ও গম মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ টনের মতো দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান মতে, গত বছর দেশে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৬২ লাখ টনের মতো, যা দেশকে খাদ্যে সয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
চলতি মওসুমে দেশে ৫২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আমনের প্রকৃত আবাদ হয়েছে ১.২০ লাখ হেক্টর বা প্রায় ৩ লাখ একর অতিরিক্ত জমিতে। ফলে আমন থেকে চলতি মওসুমে ১ কোটি ৩৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়, তা ১ কোটি ৪০ লাখ টন অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল মহল।
সারাদেশে অগ্রহায়ণের সকাল থেকে এখন আমন কাটার ধুম পড়ে যায় এবার। সকাল-সন্ধ্যা সোনালি ফসলের মাঠে মাঠে কৃষকদের ছিল যথেষ্ট ব্যস্ততা। কৃষকরা নিজের প্ররিশ্রম ছাড়াও কৃষি শ্রমিক দিয়েও সকাল থেকে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে আমনের আবাদ যেমনি বিলম্বিত হয়, তেমনি পৌষ মাসজুড়েই  তার কর্তন চলবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএইর দায়িত্বশীল মহলের মতে, ইতোমধ্যে দেশের আবাদকৃত জমির ৯০ ভাগেরও বেশি আমন কাটা শেষ হয়েছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ হার এখনো প্রায় ৫০ শতাংশের মতো। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে এখনো আমন কাটার ধুম চলছে।
বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াই এবার খরিপ-২ মওসুম পার  হওয়ায় আমনের উৎপাদন ছিল সন্তোষজনক। পাশাপাশি দামও গত বছরের তুলনায় কিছুটা ভালো হওয়ায় যথেষ্ট খুশি দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশের কৃষকরা। ভালো লাভের মুখ না দেখলেও এবার কৃষকরা লোকসান এড়াতে পারছেন। এবার আমনের আবাদ, উৎপাদন এবং এর ভালো দাম দেশের কৃষক ও কৃষি অর্থনীতিতে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও আশাবাদী কৃষি অর্থনীতিবিদরা। উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকাতেই আমন ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকা মণ দরে। দক্ষিণাঞ্চলেও আমনের দর এবার গত কয়েক বছরের তুলনায় ভালো। ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকার মধ্যে, যা মাত্র দু’বছর আগেও ছিল ৫শ’ টাকা থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকার মধ্যে।  চাল আমদানিতে সরকার অতিরিক্ত কর আরোপ করায় ধানের বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। এর ফলে এবার বোরো আবাদেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশাবাদী মাঠপর্যায়ের কৃষিবিদরা।
একসময়ে দেশের প্রধান দানাদার খাদ্যশস্য হিসেবে আমনকে বিবেচনা করা হলেও গত কয়েক দশকে বোরো আবাদে বিপ্লব ঘটায় আমন এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এরপরও আমনের গুরুত্ব দেশের খাদ্য নিরাপত্তাসহ কৃষি অর্থনীতিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে।  এমনকি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এখনো আমন প্রধান দানাদার খাদ্যশস্য হিসেবেই তার অবস্থান ধরে রেখেছে। বরিশাল কৃষি অঞ্চলে চলতি মওসুমে প্রায় ৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের মাধ্যমে ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল পাবার লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।  
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রী প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত প্রায় পাঁচ দশকে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড এবং প্রায় ৪০টি আমনের জাতসহ ৭০টি উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন উফশী জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে।  এমনকি ব্রী ইতোমধ্যেই বন্যা ও লোনা পানি সহিষ্ণু আমন ধানের জাতও উদ্ভাবন করেছে। ব্রী উদ্ভাবিত আমনের উফশী জাতের ধান থেকে হেক্টরপ্রতি ৪ টন পর্যন্ত চাল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব উফশী জাতের আমন বীজ এখনো দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের তৃণমূল পর্যায়ে না পৌঁছলেও গত বছর পর্যন্ত মোট আবাদকৃত জমির প্রায় ৮০ ভাগই ব্রী উদ্ভাবিত ধান আবাদ হয়েছে। শুধুমাত্র দক্ষিণাঞ্চলেই এখনো স্থানীয় সনাতন জাতের কম উৎপাদনশীল আমন বীজ আবাদের আধিক্য রয়েছে বলে ডিএইর পরিসংখ্যানে জানা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ