ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী : গোটা আকাশ নীল। দিনগুলো রোদ-উজ্জ¦ল, বিকালগুলো হলুদ। পরিবর্তনটা যেন হঠাৎই। ঘাসের ডগা ভিজে উঠছে শিশিরে, সকালে-সন্ধ্যায়। বাজারে উঠে গেছে নতুন সবজি, স্টেডিয়ামে ফুটে উঠেছে ফুটবল-ক্রিকেট। শীত আসছে নয়, এসে গেছে।
গুটি গুটি পায়ে শীত নামছে গ্রামে-নগরে। তারপরও শীত এখনো যেন লাজুক কিশোরী, আসি আসি করেও লজ্জা কাটিয়ে বন্ধ ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না জনারণ্যে। লজ্জাটা কেটে যাবে এক সময় খুব তাড়াতাড়ি হয়তো। জানুয়ারিতেই ঝাঁকিয়ে নামবে শীত। সাগর থেকে বয়ে আসা দখিনা ভেজা বাতাস দিক বদলাচ্ছে এখন। ক’দিন পরেই সাইবেরিয়ার হিমশীতল শুকনো বাতাস বইতে শুরু করবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে।
শীতের খুব সকালে কুয়াশা ধোঁয়া ক্ষেত থেকে মটরশুটি তুলেছেন কখনো? গায়ে চাদর জড়িয়ে চোখ-মুখে ভেজা কুয়াশা মেখে গাছ থেকে নামানো খেজুর রস খেয়েছেন কখনো? গরম ভাপা পিঠা তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে মুখ পুড়িয়েছেন কখনো? শীতের দ্রষ্টব্য এখন উত্তরে ওই হিমেল হাওয়া। নবান্ন না থাক, আল্পনা না থাকÑ শীতকাল তবু চেনা যায়। ধানে-গানে-পিঠে-পুলিতে, খেজুরের রসে কিংবা অতিথি পাখির কূজনে।
উত্তরের ফুরফুরে হাওয়া। এ সময়টাতেই ডানা মেলে ভেসে আসে উত্তরের অতিথি শীতের পাখিরা। প্রতি বছরই ওরা আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির সেসব পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বর্ণিল প্রকৃতির জীবন্ত এক মনি পাখি। প্রতি শীতের বছর শীতের শুরুতে বাংলাদেশের জলাশয়গুলো ছেয়ে যায় যাযাবর পাখির ঢলে। ওদেরই আশেপাশে ভিড় জমায় বিচিত্র সব দেশি পাখি। শুভ্র আকাশে, নিষ্পন্দ বাতাসে ওরা মেলে ধরে ডানা। সৌন্দর্যে অতিথি পাখির আনাগোনা যেন ভিন্ন এক মাত্রা।
অক্টোবরের শুরু থেকেই সাধারণত অতিথি পাখিদের আগমন শুরু হয় বাংলাদেশে। শীতটা কাটিয়ে আবার ওরা পাড়ি জমায় নিজ দেশে। এরই ভেতর পাখি প্রেমিকরা মন ভরে দেখে নেয় তাদের। প্রতি বছর এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করে অনেকেই। কিন্তু এবার যেন কিছু একটা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলগুলো এমনিতেই অতিথি পাখির জন্য বিখ্যাত। এবার এই প্রথমবারের মতো দেখা গেল, ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি সেখানে লুটোপুটি খেলছে না। গেল বছর নভেম্বরের গোড়ার দিকে ডজনখানেক প্রজাতির অতিথি পাখি এসেছিল সেখানে। ওরা দেখল বসবাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ আর নেই। দেরি করেনি ওরা, দ্রুতই চলে গেছে, প্রতি বছরই অল্প কিছু পাখি পরিবেশের অবস্থা দেখার জন্য আসে। এরা ফিরে গিয়ে দলের পাখিদের জানায় পরিবেশের অবস্থা কী রকম। ক’সপ্তাহ আগে আবার এসেছে পাখি, সংখ্যায় এবারে আগের চেয়ে একটু বেশি। প্রতি বছর যেখানে হাজার হাজার পাখি আসত, এবার সেখানে এমনকি একশ পাখিও আসেনি। এ পাখিগুলোও যদি কোনো কারণে ফিরে যায়, তাহলে এ মৌসুমে আর কোনো অতিথি পাখির দেখা মিলবে না। অতিথিরা অন্য আশ্রয়েই চলে যাবে।
অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখে, হাজার হাজার পাখি এ সময়টাতে কোথা থেকে উড়ে আসে, তারপর কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চলে আসছে পাখিদের এই সাময়িক আসা-যাওয়া। প-াইস্টোসিন হিমযুগে পৃথিবীর উত্তর বরফে ঢেলে গেলে বাঁচার তাগিদে পাখিরা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় দক্ষিণ গোলার্ধে। অবস্থা বদলে গেলে পাখিরা আবার ফিরে আসে নিজ ভূখ-ে। এভাবে পাখিদের জীবন জন্ম নেয় স্থানান্তরে এ যাওয়া-আসা। দিনের আলো যখন উত্তর গোলার্ধে কমতে থাকে, পাখিদের প্রজনন গ্রন্থি তখন নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। সে সঙ্গে দেশান্তরে যাওয়ার জন্যে চঞ্চল হয়ে ওঠে ওরা।
দেশান্তরী এসব পাখির মূল বাসভূমি শীতপ্রধান এলাকা। সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। শীত বাড়তেই এরা পাড়ি জমায় হাজার মাইল দূরদেশে। প্রাণী বিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণির। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখিরা অনাবাসিক শ্রেণির।
শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছেÑ বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখাচখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়Ñ নাম না জানা কতো কি পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪-১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও, ওয়েল, পিগটেইল, ডাটাস্মক, থাম, আরাথিল, পেরিক্যান, পাইজ, শ্রেভির, বাটানÑ এসব পাখি এসে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখিদের মধ্যে পৃথিবীর চৌম্বক শক্তিকে সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করার বিস্ময়কর এক ক্ষমতা আছে। পথের নিশানা এদের ভুল হয় না কখনো। কোথায় কত উচ্চতায় অনুকূলে বাতাস মিলবে, সেটি অনুভব করার শক্তিও আছে এদের। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও এরা আগেভাগেই পেয়ে যায়। সে জন্যে নিজ দেশে যখন শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকে, তখনই দেশত্যাগ করতে শুরু করে ওরা।
ওই যে বর্ণিল অতিথিরা, ওরা কেন আসবে বাংলাদেশে? কী এমন আকর্ষণ আছে এখানে? ওদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই তো শুরু হয় পাখি শিকারিদের আনাগোনা। শিকারির রক্তে জাগে খুনের নাচন। বন্দুকের নলে চকচকে করে লোভ। ৭৩-এ বন্যা জন্তু (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ অনুসারে জীবজন্তু হত্যা, ফাঁদ পেতে ধরা বা অন্য কোনো উপায়ে ক্ষতি করা আইনত দ-নীয়। কাগুজে এ আইনের ভয়ে শিকারিরা দমে না। শৌখিন পাখি শিকারিদের উপদ্রব তাতে খানিকটা কমলেও পেশাদার পাখি শিকারিদের তৎপরতা একটুও কমেনি। শীতের পাখি আসা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওর এলাকায় ধূম পড়ে যায়। নানা রকমের জাল, পিঞ্জর, ফাঁদ তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। হাওর এলাকায় মানুষের নির্ভরতা বছরে একটি মাত্র ফসলের উপরে, সে কারণে অনেকেই শীত মৌসুমে পাখি শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করে। পাখি শিকার মানেই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর নৃশংসতা। বাজারে দশ-বিশ-একশ টাকায় অতিথি পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়। রাতের বেলা জালের সাহায্যে ফাঁদ পেতে বন্দি করা হয় পাখিদের। দিনে এয়ারগান, বন্দুক, রিভলবার- এসব ব্যবহার করে মারা হয়। এখানে একটি ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া দরকার যে, পাখি শিকারের অস্ত্র হিসেবে প্রধানত এয়ারগান ব্যবহার করা হয়। কার্যকারিতার দিক থেকে পাখি মারা ছাড়া আর কোনো কাজে এয়ারগানের ব্যবহার নেই। এয়ারগান কেনা আর লাইসেন্স করার উদ্দেশ্য একটাইÑ পাখি শিকার। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এসব যে জানেন না, তা নয়। ভালোই জানেন তারা। কিন্তু সব জেনেও কেন এয়ারগান ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে না?
সৌন্দর্যই শুধু নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। সেটিই যদি হয়, তাহলে নির্ভর করতেই হবে কীটনাশকের ওপর। কিন্তু এটি তো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি বেশি সে দেশে পর্যটকের সংখ্যাও বেশি। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার।
যে পাখি নিসর্গকে এত সুন্দর করে, চোখকে এত প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে এত আলোড়িত করে, নিরীহ সে পাখির প্রাণ নেওয়াতে কী এত সুখ মানুষের?
পাখিরা আসুক। ওদের কলকাকলীতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। শিকারির বন্দুকের আঘাতে যেন ডানা ভেঙে থুবড়ে না পড়ে কোনো পাখি। সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে প্রয়োগ করতে হবে কার্যকরভাবে। তৎপরতা বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনকে। পাশাপাশি হাওর এলাকার মানুষদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার। মানুষের ক্ষুধায় সবকিছু দাহ্য, পাখি তো বটেই। প্রকাশ্যে রাজপথে পাখির বিপণন বন্ধ হলে যে পাখি শিকার প্রবণতা কমে যাবে, সেটি সহজেই বোঝা যায়। পাখি নিধনের তা-ব বন্ধে বেশি কিছু নয়, ওদের জন্য শ্রেফ একটু ভালোবাসা, একটু প্রাণবিক উষ্ণতা চাই। আমাদের, এ মানুষদেরই তো অতিথিÑ ওসব বর্ণিল পাখি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।