Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলাম : একটি কোণঠাসা সভ্যতা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের ‘ইসলামিক আর্ট’ শাখাটি নাম বদল করে ‘আর্ট অফ দ্য আরব ল্যান্ডস, তুরস্ক, ইরান, মধ্য এশিয়া এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়া’ হয়ে ওঠে। জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এমন একটি বিশ্বে তীব্র চাপের সম্মুখীন, যেখানে পুনরায় নামকরণের অনুশীলন করা হয় এবং শব্দার্থগুলোকে ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়। এটি এবং অনুরূপ নামকরণগুলো ইসলামকে বৃহত্তরভাবে ভেঙেচুরে কোনঠাসা করে দেয়াকে প্রতিফলিত করে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে আরো গভীর বিভক্তিকে প্রকাশ করে। ইসলাম একসময় আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আরব সাগর, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সর্বোচ্চ রাজত্ব করেছে। এই এলাকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলাম এখনও প্রধান ধর্ম। কিন্তু বর্তমানে এটি আসলে কতোটা ইসলামী? কয়েক দশক ধরে লোকেরা বিভিন্ন স্থানে ইসলামের নামে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার সহ্য করছে, বোমা-বিস্ফোরিত সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করছে, নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং দুর্বল স্বরাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলাফলের সাথে লড়াই করছে। শান্তিপূর্ণ ইসলামের বিশ্ব আজ যুদ্ধের বিশ্ব হয়ে উঠেছে।

বিশ^জুড়ে ইসলামের বিস্তার একচেটিয়া না থাকলেও বিখ্যাত পর্যটক এবং তাঞ্জিয়ারের ইতিহাসবিদ ইবনে বতুতা স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং মিসর থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ইসলামের অনুশীলন, এর অনন্য ধর্মীয় শব্দভান্ডার এবং উদার সংস্কৃতির কারণে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখনকার ইসলামী বিশ্ব ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্পর্কে উদার ছিল। ইসলামের একটি সভ্যকরণের ক্ষমতা ছিল, যা এখন বেদনা ও বিষণ্নতা বহন করে এবং ইসলামী অতীত ও বিচ্ছিন্ন বর্তমানকে সংযুক্ত করে। একারণে, কবি মাহমুদ দারবিশ তার ‘ইলেভেন স্টার ওভার আন্দালুসিয়া’ কবিতায় প্রাচীন ইসলামী রাষ্ট্র আল-আন্দালুসের পতন এবং তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনের পতনের বেদনাকে একই সমান্তরালে দাঁড় করাতে পেরেছেন। এটি ছিল এমন একটি ইসলামী বিশ্ব, যেখানে সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যগুলো সনাক্তকরণের প্রাথমিক কোনো উপায় ছিল না। প্রাচীন আন্দালুসে ইসলাম অন্যান্য ধর্র্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈষম্যহীন একটি সভ্যতা তৈরি করেছিল, যা এক সময় কালের অতলে হারিয়ে গেছে। অথচ, সমসাময়িক যুগে এর বিপরীত প্রক্রিয়া প্রতিফলিত হয়।

আল-আন্দালুস ছিল একটি নতুন বিশ্ব যা আইবেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং ইসলামিক প্রাচ্যের অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করেছিল। প্রাচীন স্পেন বা হিস্পানিয়া থেকে আল-আন্দালুস অঞ্চলের আরবি নামটি একটি বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বের দিকে উপদ্বীপটির পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রটিতে ইসলামী ভাষায় রাজনৈতিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক এবং ইসলামবাদী বক্তৃতা এবং সব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। ইসলামের পতাকাতলে সভ্যতাটিতে, এমনকি অমুসলিমরাও আল-আন্দালুসের সমৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছিল। প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মাইমোনাইদ্স হিব্রু লিপিতে অনুবাদ করে আরবি ভাষায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। রামন লুল, একজন খ্রিষ্টান রহস্যবাদী যিনি আরবি এবং কাতালান ভাষায় লিখতেন, তার সুফিভাবের বিকাশ ঘটাকালীন যীশুখ্রিষ্টের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে তিনি আল্লাহর ৯৯টি নামের সাহায্য নেন। অন্যরা, যেমন মিসরীয় আহমদ শাওকি এবং দক্ষিণ এশীয় মুহম্মদ ইকবাল বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন এবং সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের একটি সেরা সময় হিসেবে আন্দালুসের ইসলামী শাসনকে বর্ণনা করেছেন।

ইতিহাসবিদরা আল-আন্দালুসের রাজনীতি এবং যুদ্ধের সাথে পরিচিত হলেও তারা এবং অন্যরা এ অঞ্চলের ধর্ম ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখতে সংগ্রাম করেছেন। দ্বীপাঞ্চলটির জনসংখ্যাগত ধর্ম যাই হোক না কেন, ১৩ শতকের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাগুলোর বেশিরভাগই আঞ্চলিক পরিচয়ের একাত্মতার মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিল। সেসময়য়কার বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুসারীদের নিজেদেরকে শুধুমাত্র ‘আন্দালুসিয়ান’ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়। শহুরে অভিজাতদের মধ্যে, সাহিত্যে ও সাধারণ আন্দালুসিয়ানদের জন্য মূলত আরবি ভাষাই প্রধান ছিল। আন্দালুসিয়ান স্থাপত্যের অস্তিত্ব উত্তর আফ্রিকা এবং উপসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আন্দালুসিয়ান সংস্কৃতি সহজাতভাবে ইসলামিক ছিল। কিন্তু তারপরেও এতে মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতির সন্নিবেশ ছিল। আইবেরিয়ার ক্যাথলিক ধর্ম পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে স্পেন অনেক ক্ষয়-ক্ষতি সহ্য করেছে। তারপর সেখানে একটি ধারাবাহিক বর্বরতার মাধ্যমে অ-ইসলামীকরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ এবং বহিষ্কার (মুসলিম ও ইহুদিদের) এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ঘটেছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে এবং অযৌক্তিকভাবে পৌরাণিক কাহিনীর রচয়িতারা আন্দালুসিয়ার ইসলামী সময়কালকে স্পেনের ঐতিহাসিক বিবর্তনের পাদটীকায় নামিয়ে এনেছেন। স্পেন তার দর্শন, ভাষা, সাহিত্য এবং আরও অনেক কিছুতে নিজস্ব ধ্রুপদী ইসলামিক অতীত মুছে দিয়েছে। এখন, তেল আবিবের তুলনায় মাদ্রিদে আন্দালুসিয়ান লেখক, দার্শনিক এবং সূফীবাদীদের নামে নামকরণ করা রাস্তাগুলো সংখ্যাও কমে গেছে। আল-আন্দালুসের এই অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়ার বেদনাকে প্রায়শই ক্রুসেড, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর ও ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সাথে তুলনা করা হয়। ইসলামিক সভ্যতায় আরবি ভাষার পাশাপাশি আরও কয়েকটি ভাষার শক্তিশালী সাহিত্য ঐতিহ্য রয়েছে। এই ইসলামী ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফারসি ও উর্দু, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমাদের সাথে সম্পর্কিত ভাষা। কিন্তু ইসলামী সভ্যতায় ব্যবহত হয় বলে, ভারতে কমতে শুরু করেছে ভাষগুলোর ব্যবহার।

১৮ শতকের পর থেকে, ভারত ইসলামী শাসন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে এবং পরবর্তীতে একটি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে, যা এখনও তার ইসলামিক অতীত এবং বর্তমানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। ভারত রাষ্ট্রের জন্ম যদি প্রচন্ড ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে হয়ে থাকে, যেমনটি প্রায়শই বলা হয়, তাহলে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের মুসলিমরাও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা, বিভিন্ন বিভাজন এবং দাঙ্গার আঘাতে অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপমহাদেশে ইসলামী শাসনের পতন এবং পরবর্তীকালে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে স্বজাতি হত্যা এবং ভৌগোলিক বিভক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত ক্ষতিকর সুতাটি এখানে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিহিত রয়েছে। মুসলিমদের জন্য এই বেদনা কুরআন নাজিলের সময় থেকেই প্রকট। যেমনটি মহানবীর (সা:) সাহাবী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই এই কুরআন বেদনা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তিলাওয়াত করলে কাঁদ। যদি কাঁদতে না পার, তবে কন্ঠ শোকাতুর কর। মিষ্টি সুরে আবৃত্তি কর, কেননা যে মিষ্টসুর ব্যবহার করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। সূত্র : নিউজ লাইন্স ম্যাগাজিন।



 

Show all comments
  • aman ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:১৮ এএম says : 0
    ইসলামের সুশীতলে থাকলে সবাই নিরাপদ থাকবে
    Total Reply(0) Reply
  • মর্মভেদী ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:২২ এএম says : 0
    ইসলামকে মেনে নিয়ে এর নিয়মে চললে সারা বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে
    Total Reply(0) Reply
  • Kma Hoque ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:২০ এএম says : 0
    বর্তমানে নেতারা ইসলামের সংস্কৃতি মানতে চায় না। যার কারণেই বিশ্বে নানান রকম সমস্যা লেগেই আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Tutul ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:১৮ এএম says : 0
    ইসলাম এক সময় সারা বিশ্বে শাষণ করছে। ইনশা-আল্লাহ আবার ইসলাম সারা বিশ্বে শাষণ করবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ