Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সরকারের শত কোটি টাকায় দফায় দফায় নৌযান সংগ্রহ হলেও বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বন্ধ ১১ বছর

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৩৫ এএম

বরিশালÑচট্টগ্রাম রুটে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন নির্বিঘœ ও নিরাপদ করতে সরকারের শতাধীক কোটি টাকায় ৩টি নৌযান সংগ্রহ ও ২টির পূণর্বাশনের পরেও উপক’লীয় দুটি বিভাগীয় সদরের মধ্যে নিরাপদ নৌ যোগাযোগ সচল করার উদোগ নেই বিআইডব্লিউটিসি’র। এমনকি গত দুই দশকে বরিশালÑচট্টগ্রাম রুটের কথা বলেই নৌযান সংগ্রহ ও পূণর্বাশনে সরকারের কাছ থেকে কয়েক দফায় বিপুল অর্থ গ্রহন করেও রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি এ রুটে নিরাপদ নৌযোগাযোগ নিশ্চিত করণে খুব আগ্রহী নয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে বরিশাল থেকে ভোলাÑহাতিয়াÑসন্দ্বীপ হয়ে চট্টগ্রামের নিরাপদ নৌ যোগাযোগের ভবিষ্যত এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। উপরন্তু অতি সম্প্রতি ঢাকাÑচাঁদপুরÑবরিশাল রকেট স্টিমার সার্ভিসটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পৌছতে ২৪ ঘন্টারও বেশী সময় লাগছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চল থেকে নৌপথে চাঁদপুর হয়ে রেলপথে চট্টগ্রাম পৌছার বিকল্প পথটিও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চরম দূর্ভোগে দক্ষিণাঞ্চল থেকে চট্টগ্রামগামী সাধারন যাত্রীরা।
সর্বশেষ প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যায়ে বরিশালÑভোলাÑহাতিয়াÑসন্দ্বীপÑচট্টগ্রাম রুটের জন্য ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ’ ও ‘এমভি আইভি রহমান’ নামের দুটি উপক’লীয় যাত্রীবাহী নৌযান সংগ্রহের পরে গত বছর ২ ডিসেম্বর পরিক্ষামূলক পরিচালন সম্পন্ন হয়। তবে নানামুখি প্রতিবন্ধকতার কথা বলে গত প্রায় এক বছরেও এর বানিজ্যিক পরিচালন শুরু করেনি রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। তবে নৌযান দুটি বরিশালÑচট্টগ্রাম রুটের পরিবর্তে চট্টগ্রামÑহাতিয়া এবং কুমিড়াÑগুপ্তছড়া রুটে চলছে।
এমনকি বরিশালÑচট্টগ্রাম রুটের কথা বলেই চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে ২০০২ সালে প্রায় ৩৩ কোটি টাকায় ‘এমভি বার আউলীয়া’ নামের একটি নতুন নৌযান সংগ্রহ ছাড়াও ২০০৯ সালে আরো প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যায়ে ‘এমভি আবদুল মতিন ও এমভি মনিরুল হক’ নামের দুটি উপক’লীয় নৌযান পূণর্বাশন করা হয়। ‘এমভি বার আউলীয়া’ সংগ্রহের পরে গত ২০ বছরে তার পূণর্বাশন ও নতুন ইঞ্জিন সংযোজনে আরো প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে। এসব কিছুর বাইরেও বিশ^ ব্যাংকের সুপারিশে দেশের উপক’লভাগে নিরাপদ যাত্রী পরিবহনকে সরকার ‘গন দায়বদ্ধ সেবাখাত’ হিসেবে ঘোষনা করে প্রতি বছর বিআইডব্লিউটিসি’কে নগদ ভতর্’কিও প্রদান করে আসছে।
কিন্তু এতসব কিছুর পরেও দেশের উপক’লীয় দুটি বিভাগীয় সদরের মধ্যে নিরাপদ নৌ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ ২০১১ সালের মে মাস থেকে। গত বছর ২ ডিসেম্বর বরিশালÑচট্টগ্রাম নৌপথে ‘এমভি তাজউদ্দিন আহদমদ’কে নিয়ে পরিক্ষামূলক পরিচালনের পরে বিআইডব্লিউটিসি’র তরফ থেকে নৌপথটির ‘বামনীর নালা’ ও ‘সেলিম বাজার টেক’ এলাকায় নাব্যতা উন্নয়নের অনুরোধ জানান হয়। সে প্রেক্ষিতে অনেক আগেই ঝুকিপূর্ণ ঐ এলাকায় ড্রেজিং সম্পন্ন করে পুরো নৌপথটিকে নুন্যতম ১৫ ফুট গভীরতার নৌযান চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে বলে বিআইডিব্লিউটিএ’র চট্টগ্রাম জোনের পরিচালন পরিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র পরিচালকÑবানিজ্য আশিকুজ্জামানের সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, বরিশালÑচট্টগ্রাম নৌপথের ভাষানচরের কাছে ‘বামনীর নালা’ ও তার উজানে ‘সেলিম বাজার টেক’ এলাকায় নাব্যতা সংকট রয়েছে। ফলে উপক’লীয় নৌযানগুলো ঐসব ঝুকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করেতে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একারণে যাত্রীবাহী নৌযানগুলোকে বরিশাল বা চট্টগ্রামে পৌছতে দীর্ঘ সময় নদীতেই নোঙরে থাকতে হবে বিধায় উপক’লীয় যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিসটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু বিআইডব্লিউটসি’র এসব বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষন করেছেন বিআইডব্লিউটিএ’র দায়িত্বশীল মহল। তাদের মতে চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়া হয়ে ভোলার ইলিশাঘাট পর্যন্ত কোথাও নুন্যতম নাব্যতা সংকট নেই। তবে অপর একটি সূত্রের মতে, গত বছর সংগ্রহ করা বিআইডব্লিউটিসি’র ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ ও এমভি আইভি রহমান’ নৌযান দুটির গতি ১০ নটের বেশী নয়। অথচ ভাটার সময় ইলিশাঘাট থেকে হাতিয়া হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৭Ñ৮ নট গতিতে পানি সাগরে পতিত হয়। ফলে এসব নৌযান সাগর মুখি প্রবল শ্রোত অতিক্রম করে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে পৌছতে ১৮Ñ২০ ঘন্টারও বেশী সময় লাগবে বলে মনে করছেন কারিগরি বিশেষজ্ঞগন। গত বছর ২ ডিসেম্বর পরিক্ষামূলক পরিচালনে এমভি তাজউদ্দিন আহমদ ১৯ ঘন্টায় গন্তব্যে পৌছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান শিপিং করপোরেশন পশ্চিম জার্মেনী থেকে সংগ্রহ করা ৪টি উপক’লীয় যাত্রীবাহী নৌযানের সাহায্যে চট্টগ্রামÑনারায়নগঞ্জÑবরিশালÑচট্টগ্রাম ও বরিশালÑহাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে উপক’লীয় স্টিমার সার্ভিস চালু করে। তৎকালীণ পাকিস্তানের শাষক আইয়ুব খানের কণ্যাদের নামে ‘এমভি জাকিয়া, এমভি জরিনা, এমবি জোহরা ও এমভি জোবেদা’ ঐসব নৌযানের নামকরন করা হলেও পরবর্তিতে ’৬৯-এর গনঅভ্যুথ¥ানের শহিদদের নামে নামকরন করা হয়। ‘এমভি আবদুল মতিন, এমভি মনিরুল হক, এমভি আলাউদ্দিন আহমদ, ও এমভি তাজুল ইসলাম’ নামের নৌযানগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে পূর্ণবাশনও করা হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যায়ে।
কিন্তু ব্যাপক দূর্নীতি ও অনিয়মের কারণে নৌযান দুটি খুব বেশীদিন নির্বিঘেœ চলেনি। ফলে ২০১১ সালের মাধ্যভাগ থেকে বরিশালÑচট্টগ্রাম উপকূলীয় স্টিমার সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে নৌযান দুটি বিক্রীর সিধ্বান্ত গ্রহন করেছে সংস্থাটি। ‘এমভি তাজুল ইসলাম’ স্বাধিনতার পরেই বিক্রী করা হয়েছে।
অপরদিকে ২০০২ সালে সংগ্রহ করা ‘এমভি বার আউলীয়া’ নৌযানটিতেও সংগ্রহের কয়েক বছরের মধ্যে কারিগরি ও যান্ত্রিক ত্রুটি শুরু হয়। ইতোমধ্যে দু দফায় ভারি মেরামত ও পূণর্বাশন শেষে গত বছর মূল ইঞ্জিন পরিবর্তনের পরে যাত্রী পরিবহনে ফিরলেও বরিশালের পরিবর্তে অন্য রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। তবে গত অক্টোবর থেকে এমভি বার আউলীয়া মাসিক প্রায় ১১ লাখ টাকা ভাড়ায় কক্সবাজারÑসেন্টমার্টিন রুটে প্রমোদ ভ্রমনের জন্য চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উপক’লীয় নৌযোগাযোগ নির্বিঘœ করতে আরো দুটি উপক’লীয় নৌযান সংগ্রহের লক্ষে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৫০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যায় সাপেক্ষ একটি ডিপিপি একনেক-এর চুড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। প্রায় এক বছর পরে ৭শ যাত্রী বহনক্ষম উপক’লীয় নৌযান ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ’ নির্মানের লক্ষে বিআইডব্লিউটসি’র সাথে ‘থ্রি এ্যাংগেল মেরিন লিমিটেড এন্ড দি কুমিল্লা শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড জেভি’র সাথে ১৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০ মাসে সরবারহের কথা থাকলেও তিন দফায় ৪ বছর সময় বাড়িয়ে ৬৮ মাস পরে গত বছর এপ্রিলে নৌযানটি হস্তান্তর করে। প্রায় ১৯৭ ফুট দৈর্ঘ ও ৩৯.৩৬ ফুট প্রস্থ এ নৌযানটিতে বেলজিয়ামের ‘এবিসি’ ব্রান্ডের মাত্র ৭শ অশ^ শক্তির ইঞ্জিন সংযোজন করায় এর সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় মাত্র ১৮.৫২ কিলোমিটার।
অপরদিকে চট্টগ্রামের ‘এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড’ এর সাথে ৫শ যাত্রী বহক্ষম অপর উপক’লীয় নৌযান, ‘এমভি আইভি রহমান’ নির্মানের লক্ষে ২০১৫-এর ডিসেম্বরে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ২০ মাসের পরিবর্তে ৪ দফায় আরো ৪৮ মাস সময় বাড়িয়ে গত বছর এপ্রিলে তা হস্তান্তরের পরে গত বছর ৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি নৌযানই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
তবে এ দুটি নৌযন যথাক্রমে চট্টগ্রামÑহাতিয়া ও কুমিড়া-গুপ্তচড়া রুটে যাত্রী পরিবহন করছে। ১৬৪ ফুট দৈর্ঘ ও প্রায় ৩৫ ফুট প্রস্থ ‘এমভি আইভি রহমান’এ বেলজিয়ামের এবিসি ব্রান্ডের মাত্র সাড়ে ৪শ অশ^ শক্তির দুটি মূল ইঞ্জিন রয়েছে। ৫শ যাত্রীবহনক্ষন এনৌযানটিও পূর্ণ লোড নিয়ে ঘন্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল বা ১৮.৫২ কিলোমিটারের বেশী গতিতে চলতে পারছে না। যাত্রী ও পণ্য মিলিয়ে নৌযানটির বহন ক্ষমতা মাত্র ১২৫ টন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নৌ পরিবহন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ