Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শীতের আগমনে শঙ্কা বাড়াচ্ছে নিউমোনিয়া

 বছরে মারা যায় ২৪ হাজার শিশু  ভ্যাকসিনের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ  অক্সিজেন স্বল্পতা নির্ণয়ে ব্যবস্থা নেই

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ভোরের শিশিরে পড়া সূর্যরশ্মি মুক্তার মতো আলো ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, শীত আসছে। অনেকের কাছে হিম হিম এ শীতের আমেজটা উপভোগ্য ও রোমাঞ্চকর। তবে অনেকের জন্য এটি বেদনার কারণও হচ্ছে। কারণ, শীত তার সঙ্গে করে নিয়ে আসে ঠান্ডাজনিত অনেক রোগ-বালাই। বিশেষ করে শিশুদের রোগ-ব্যাধি এসময় বেশি হয়। শীত ঝুঁকি বাড়ায় শিশুদের প্রাণ-সংহারি নিউমোনিয়া রোগের। প্রতিবারের মতো এবারও হাসপাতালগুলোতে এখনই দেখা যাচ্ছে নিউমোনিয়া-আক্রান্ত শিশুদের ভিড়।

মরিয়ম আক্তার, দুই বছরের কন্যাশিশু নিয়ে ভর্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। নিউমোনিয়া-আক্রান্ত এ শিশুই তার প্রথম সন্তান। মরিয়ম বলেন, চিকিৎসকরা বলছেন আমার বাচ্চার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ) প্রয়োজন। দু’দিন ধরে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তির জন্য চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। কোনো শয্যা খালি নেই।
মরিয়ম আক্তারের মতো এমন অনেক উদ্বিগ্ন অভিভাবক সন্তানকে ঢাকা মেডিকেলের এনআইসিইউতে ভর্তির আশায় আবেদন জমা দিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র জানা গেছে, এনআইসিইউতে মাত্র ৪২টি শয্যা আছে। সবগুলোই রোগীতে পরিপূর্ণ। শিশুদের একটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ৩০ জনের ১১ জনই নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি।

জানা গেছে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি হাজারে ৩৬১ জন শিশু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর বছরে মৃত্যু হচ্ছে ২৪ হাজার শিশুর। হাসপাতালে ৪৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এ রোগে সেবাগ্রহীতার ৪২ শতাংশের রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি (হাইপোক্সেমিয়া) দেখা যায়। অথচ দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে তাদের ১৩ শতাংশের মৃত্যু ঘটে প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন-স্বল্পতার কারণে, যা শঙ্কার কারণ হবে এই শীতেও।

দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের একটি বড় অংশের শিশুর জন্য এনআইসিইউ প্রয়োজন হয়। তবে চাহিদার তুলনায় এর স্বল্পতা রয়েছে। এ সংকট নিরসন না হলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনিসেফ।

শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি বলছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু অক্সিজেন-স্বল্পতায় ভুগছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয় না। রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা ও মেডিকেল অক্সিজেনের অপ্রতুলতা শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পালস অক্সিমিটার দিয়ে এটি মাপা যায়। কিন্তু শিশুদের পরিস্থিতি মাপার জন্য এ যন্ত্র পাওয়া দুষ্কর। তাই শিশুর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া, দ্রুত শ্বাস নেওয়া, গলার মাংস ফুলে যাওয়া ও বুকের খাঁচার নিচের অংশ দেবে যাওয়া দেখে অক্সিজেন স্বল্পতা নির্ণয় করে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত শিশুরা নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ধনী পরিবারের শিশুদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেক। এমনকি পঞ্চম জন্মদিনের আগেই তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

তিনি বলেন, নিউমোনিয়ার কারণে ‘শিশুমৃত্যু বন্ধের সম্ভাবনা’র অগ্রগতি সেভাবে ত্বরান্বিত হয়নি। এজন্য স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি ও বায়ুদূষণসহ আন্তঃখাত সমন্বয়ে প্রকল্প প্রয়োজন। ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকারকে নিউমোনিয়া মোকাবিলায় সহায়তা করে।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের যদি হাইপোক্সেমিয়া (রক্ত অক্সিজেন ঘাটতি) হয় এবং যদি তারা সময় মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না পায়, তাহলে মৃত্যু হতে পারে। দ্রুত অক্সিজেনের যোগান দিলেই কেবল তাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে। সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা বলেন, অপর্যাপ্ত সেবা, অপুষ্টি এবং বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তের অধিকাংশই শিশু। ভ্যাকসিনের চাহিদা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন নিউমোভ্যাক্স ২৩-এর চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক সীমিত।
তিনি বলেন, সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড ভ্যাকসিন তৈরি করে। কয়েক বছর এ ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রেখেছে তারা। তবে বিভিন্নভাবে দেশে ফাইজারের তৈরি নিউমোনিয়া প্রতিষেধক আরেকটি ভ্যাকসিন বাজারে আসছে। তবে কয়েক বছরে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে দাম। ২০১৯ সালে এর দাম ছিল এক হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে পাঁচ হাজার ৫৭০ টাকা গুনতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন পরিচালক (মা, নবজাতক শিশু ও কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য) মো. শামসুল হক বলেন, শীত যেহেতু আসছে, নিউমোনিয়া রোগী কিছুটা বাড়বেই। তবে নিউমোনিয়ায় সবচেয়ে ভয়ের কারণ হলো অক্সিজেনের ঘাটতি। যত শিশুর মৃত্যু হয় অধিকাংশেরই অক্সিজেনের কারণে হয়।
তিনি বলেন, সরকার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেশের ৪৪টি জেলায় নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিট (স্ক্যানু) চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জেলাগুলোতেও এ সেবা চালু করা হবে।

শামসুল হক বলেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঠান্ডা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। সেইসঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্যে গুরুত্ব দিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শীত

৩১ জানুয়ারি, ২০২৩
৬ জানুয়ারি, ২০২৩
৫ জানুয়ারি, ২০২৩
৫ জানুয়ারি, ২০২৩
৩ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ