দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানব জীবন সুখ দুঃখ হাসি কান্নায় ভরপুর। দুখের চেয়ে সুখের, কান্নার চেয়ে হাসির পরিধি অনেক ব্যাপক। যত দুঃখই হোক তার একটি সীমা আছে। মানুষের কোন আপন জন যেমন বাবা মা ভাই বোন ছেলে মেয়ে মারা গেলে অথবা তার কোন অর্থ খোয়া গেলে দুখে সে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু কয়েকদিন, কয়েক মাস পার হয়ে গেলে আর এই দুঃখ তাকে এতটা নাড়া দেয় না। সে স্বাভাবিক হয়ে যায়। মানুষের দুখ যদি সুখের মত ব্যাপক হতো তবে সে চলতে পারত না। তার জীবন হয়ে যেত দুর্বিসহ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অসংখ্য অগনিত নেয়ামত দিয়েছেন। চারিদিকে নেয়ামতে ভরপুর। এই নেয়ামতের উপর ভর করেই আমার জীবন চলে। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল পুরো জীবনের প্রতি মূহুর্তে আমি শুধু মাওলার দেওয়া নিয়ামত ভোগ করছি। মাওলার হাজার হাজার নেয়ামত আমাকে বেষ্টন করে আছে। তার নেয়ামত গননা করে শেষ করা যাবে না। তার নেয়ামত ছাড়া আমার জীবন মূহুর্তেই অচল হয়ে যায়। যেমন তার দেওয়া বাতাস যদি ক্ষনিকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়, আমি কি বেঁচে থাকার আশা করতে পারি? তার দেওয়া পানি যদি না দেন বা বিষাক্ত করে দেন, আমি কি বাঁচতে পারি? আমার সুস্বাদু খাবার, সুন্দর জামা কাপড়, আলিশান বাড়ি কোনটি কি তার দেওয়া উপকরণ ছাড়া তৈরী হয়েছে? আমার জীবন যেমন তার দান, তেমনি আমার জীবন ধারনের সব উপকরণও তার দেওয়া। পৃথিবীর কোন শক্তি আমাকে তৈরী করেনি। আমাকে নেয়ামতও দেয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষ শুধু মাওলার দেওয়া উপকরনগুলোকে পরিবর্তন করে অন্য একটি জিনিস বানাতে পারে। মাওলার দেওয়া কোন উপকরন ছাড়া আজ পর্যন্ত কোন শক্তি কি কোন কিছু বানাতে পেরেছে? আল্লাহ তায়ালা নিজেই সুরা নহলের ১৮ আয়াতে বলেন, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমূহ গননা করতে যাও তবে তোমরা তা গননা করে শেষ করতে পারবে না। আমার শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ, আকাশ পৃথিবী, চাঁদ সূর্য, গাছ পালা, নদ নদী, সাগর পাহাড়, ফুল ফল সবই আল্লাহর নেয়ামত। আমরা সারাদিন গননা করলেও তার নেয়ামত হিসাব করে শেষ করতে পারব না। আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা গ্রহ নক্ষত্র, পৃথিবীর অসংখ্য জীব জন্তু, গাছ পালা,তরুলতা শুধু আমার সেবা করেই যাচ্ছে। আমার নিকট কি তার কোন হিসাব আছে। একটি ফসলের বীজ জমিতে বপন থেকে শুরু করে আমার ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত কত ধাপ পার হয়। এই ধাপ গুলোতে আমার কাজ জমিতে বীজ ফেলা, একট সার গোবর দেওয়া, একটু নিরানি দেওয়া, প্রয়োজনে একটু সেঁচের ব্যবস্থা করা। এছাড়া আর কোন কাজ কি আমি করি? না আমার করা সম্ভব? আমার খাওয়া দাওয়া, সুস্থ থাকা, সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়া ইত্যাদি। আমার কাজ শুধু গলদকরণ করা, আর খাবার হজম হওয়া, শরীরে শক্তি যোগানো কোনও টি কি আমার সাধ্যের মধ্যে আছে?
এভাবে চিন্তা করতে থাকলে আল্লাহ তায়ালা হাজার হাজার নেয়ামত আমার উপকার করেই চলেছে। এর মধ্যে অনেক কিছু আমি দেখি আবার অনেক কিছু আমি দেখি না। তারপরও বুঝার খাতিরে ধরে নিলাম আল্লাহ তায়ালা আমাকে ১০০০ নেয়ামত দিয়েছেন। এখন একটু গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখিতো এর মধ্যে আমার জীবনে কতটি দুখের নেয়ামত আছে? এই ১০০০ নেয়ামতে মধ্যে হয়তো বা ৪-৫ টি দুখের নেয়ামত আছে।
আমাদের মধ্যে ধরুন আমার বন্ধু আব্দুল করিম অনেক বিপদের মধ্যে আছে। তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, কি আব্দুল করিম কেমন আছ? সহসাই সে জবাব দিবে আর বইলেন না ভাই বিপদে আপদে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছি, কোন উপায় দেখছি না। ঠিক আছে তার কথা আপাদ দৃষ্টিতে ঠিক। এভাবেই আসলে ভাবা হয়। সমাজের এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরাও এভাবেই ভাবতে শিখেছি। কিন্তু এবাব আমার বন্ধু আব্দুল করিমকে জিজ্ঞাসা করুন, আচ্ছা ভাই তোমার কি কি বিপদ? সে তখন আপনাকে একে একে বলতে শুরু করবে, আমার বাবা অসুস্থ, ছোট ছেলেটার টাইফয়েড, অফিসের বস খুব রাগারাগি করেন, স্ত্রী সব কিছু মেনে নেয় না। সব মিলিয়ে খুব ভাল নেই। বাবা ছেলের চিকিৎসায় মাসের ২৫ তারিখেই বেতন শেষ হয়ে যায়। নিজের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার আরো একটু এগিয়ে বলুনতো ভাই, সব মিলিয়ে তোমার ৫টি বিপদ বা সমস্যা। একটু কি চিন্তা করেছ, তোমাকে দেওয়া ১০০০টি নেয়ামতের মধ্যে মাত্র ৫টি অসুবিধা, ৫টি বিপদ আর ৯৯৫টি সুখের নেয়ামত। এখন ৯৯৫টি সুখের নেয়ামতের জন্য আমার আল্লাহর শোকরিয়া করা উচিত, না কি ৫টি বিপদের নেয়ামতের জন্য হা হুতাশ করা উচিত? এ কথা বলার পর অবশ্যই আব্দুল করিমের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে, অবশ্যই সুখের নেয়ামতের জন্য শোকরিয়া আদায় করা উচিত। অন্য দিকে যদি ১০০০ নেয়ামতের মধ্যে ৯৯৫টি দুখের নেয়ামত হত আর মাত্র পাঁচটি সুখের নেয়ামত থাকত তবে আমার অবস্থা কেমন হত? আসলে হাজারো নেয়ামতের স্মরণ হলে কয়েকটি দুঃখ কখনও কাবু করতে পারবে না, পারে না। আমরা সাধারনত দুখের কথাগুলোকে খুব বেশী মনে করি। দুঃখ মসিবত এলে খুব বেশী ভাবনায় পড়ে যাই। দুশ্চিন্তার অকুল সাগরে ভাসতে থাকি। এভাবে চলতে মন বিচলিত হয়ে পড়ে। হতাশা এসে চারিদিক ভীড় জমায়। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। কারণ শয়তান এই সময়ে আমাকে খুব আক্রমণ করে বসে। শয়তান আমার অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণ করে। আমাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করে ফেলে। সে আমাকে ভাবায় যে, আমার বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। আমার তখন ৯৯৫ টি নেয়ামতের কথা স্মরণ থাকে না। আমার স্মৃতি থেকে নেয়ামতের কথা হারিয়ে যায়। হতাশা, দুঃখ, দুশ্চিন্তা, পেরেশানীতে আমি পাকড়াও হয়ে যাই। আমার রাতের ঘুম, দিনে নিশ্চিন্তে চলাফেরা উধাও হয়ে যায়। আর আমার দুঃখ বাড়তেই থাকে। আমি অধৈর্য হয়ে পড়ি। এমনও দেখা যায় এই অস্থিরতা বা পেরেশানী অনেককে কুফরে নিয়ে যায়। এমনকি অনেকে আল্লাহ তায়ালাকে গালিও দিয়ে ফেলে। অথচ আমি যদি নেয়ামতের শোকর আদায় করতে পারতাম তবে আমি হতে পারতাম ধৈর্যশীল। আমার অন্তর হতো অনেক প্র¯স্ত^। আমার হৃদয়ে শান্তি বিরাজ করত। কোন বিপদই আমাকে কাবু করতে পারত না। আল্লাহ তায়ালাও আমার বিপদের নেয়ামত কে সুখের নিয়ামতে পরিবর্তন করে দিতেন। ডঃ আয়েদ আল কারনী তার বন্ধুর সূত্রে বর্ণনা করেন, জনৈক জর্দানী নারীর পাঁচ পাঁচটি পুত্র সন্তান। সবাই অচল। চেয়ারে বসা। স্বামী নেই। কোন ভাই বোনও নেই। নিজেই সংসার চালাতে হয়। তাকে দেখার কেউ নেই। কত বড় অসহায়! তিনি ছেলেদের সেবা করছেন। তাদের জন্য রাত্রি জাগরণ করছেন। তিনি একটি হাসপাতালে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছিলেন, তিনি হাসপাতালে প্রবেশের সময় বের হবার সবময় বলছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বার বার পড়ছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তার মধ্যে কোন উৎকন্ঠা নেই। অথচ তিনি দারিদ্র।
লেখক : শিক্ষাবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।