দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানব জীবনের দিবারাত্রির কর্মকান্ড উদাহরণত উঠাবসা, মেলামেশা, লেনদেন এর উত্তম নিয়ম-নীতিকে আদব বলা হয়। এসব আদব যতœসহ পালনের দ্বারাই মানুষ সভ্যতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, ভদ্র হয়ে থাকে,অভিজাত বলে গন্য হয়ে থাকে।সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি যদি জীবন চলার আদবের প্রতি যতœবান হয় তাহলে অপরাপর লোকজনকে অধিক প্রশান্তি পৌঁছাতে পারে এবং তাদের অশান্তি ও মন-বেদনার কারণ হয় না। এটা সর্বজন স্বীকৃত বাস্তবতা যে,অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন ধর্ম একস্থান থেকে গ্রহণ করেছে এবং আদব অন্যস্থান থেকে গ্রহণ করেছে। উদাহরণত খ্রিস্টানরা ধর্ম নিয়েছে ইঞ্জিল থেকে ; কিন্তু সামাজিকতার আদব অর্জন করেছে রোম ও ইতালি থেকে। ইসলাম এমন একটি পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা যে,তা ঈমান, ইবাদত, চরিত্র-আচরণ ও আদব-সভ্যতার আদর্শরূপে মহানবী (স) এর জীবনাদর্শকে মূল উৎস ও মাপকাঠি হিসাবে বেছে নিয়েছে। এটাই হচ্ছে কারণ যে, ইসলাম হিং¯্রতম সম্প্রদায়ের কাছেও কুরআন ও নিজ নবী মুহাম্মদ (স) এর বাণী নিয়ে তথায় পৌঁছেছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাদেরকে সভ্য ও ভদ্র জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমান সময়কার অধিকাংশ মুসলমানরাই পানাহার, উঠাবসা ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অন্যান্য পন্থা-পদ্ধতি তথা কাফির ও মুশরিকদেরকে নিজেদের ইমাম ও আদর্শ বানিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলাকে বিস্মৃত সেসব মানুষের আচার-আচরণ যা-ই এরা সামনে পায় গপ্ করে গিলে ফেলে এবং গর্বভরে তা অনুসরণ করতে থাকে। অবাকজনক কান্ড হচেছ, ঈমান গ্রহণ করেছে আরবের নবী মুহাম্মদ (স) এর প্রতি অথচ পসন্দ করছে নাস্তিক ও বেঈমান , খ্রিস্টানদের পন্থা-পদ্ধতি,রীতি -আচরণকে। নিজের মনিব নবী মুহাম্মদ (স)-কে অনুসরণ প্রশ্নে নিজেকে হেয় জ্ঞান করা, হীনমন্যতায় ভোগা মারাতœক বোকামী ও বে-আদবীর নামান্তর। আমাদের উচিত স্¦ীয় নবীর সুন্নাতের ওপর জীবন বিসর্জন করা। দুনিয়াপ্রেমিকদের চোখে সম্মানী ও ভদ্র সাজতে গিয়ে পরকালীন সম্মান-মর্যাদা ভূলে যাওয়া উচিত নয়। পরকালের অসম্মান-অপমান,লাঞ্চনা অনেক বড় ও ভয়াবহ।
কিছু মানুষ আদব বিষয়টিকে একটা ভালো কাজ মনে করে কিন্তু ততো গুরুত্ব দেয় না। এটা মারাতœক অজ্ঞতা। কেননা, মহানবী (স) ইরশাদ করেন-“আমার প্রভু আমাকে আদব-শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন, তাই তিনি সর্বোত্তম আদব শিখিয়েছেন, আমাকে।”
সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের আবশ্যক,স্বীয় জীবনকে আদব-সজ্জায় সজ্জিত করে নিজ কর্মকান্ডকে মহিমামন্ডিত করা। মনে রাখতে হবে, যে-কাজই আদবশূন্য হয় তা প্রকৃতই সৌন্দর্য, শোভনীয় ও উত্তমতা-পরিপন্থী বলে গন্য হয়। সুতরাং তা আল্লাহ্ তা‘আ‘লার দরবারেও অপসন্দনীয় হয়েই থাকবে। তার কারণ- “আল্লাহ্ তাআ‘লা অত্যন্ত সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পসন্দ করেন।”
পবিত্র কুরআনে জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টির উদেশ্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে- “তিনি জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন যেন দেখতে পারেন,তোমাদের মধ্যে কে সুন্দরতম আমল করে থাকে।”Ñ এ থেকে বোঝা গেল,আল্লাহর কাছে আমলের আধিক্যের তুলনায় আমলটি সুন্দর হওয়াই অধিক প্রিয়। সুতরাং মুমিনের উচিত , প্রতিটি আমলের ক্ষেত্রেই আদব এর প্রতি খুবই লক্ষ রাখা। প্রিয়নবীর মুল্যবান ইরশাদ হচ্ছে- “পুরো দীনই আগাগোড়া আদব-শালীনতার নামান্তর।” বঞ্চিত সে-ই পরিণতিতে পাপীষ্ট হয়েছে। তাই বলা যায়, যার আদব আছে সে ভাগ্যবান আর যার আদব নেই সে দূর্ভাগা। উম্মতের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ আদবের গুরুত্ব -তাৎপর্য বিষয়ে এমন এমন সুন্দর বাক্যসমুহ উচ্চারণ করেছেন যার কোন কোনটি উপমা-উদাহরণ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেছে। যেমন- “আদব মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ,” / “আদবের অনুরূপ আর কোন সম্পদ নেই”। বড়দের দৃষ্টিতে আদবের গুরুত্ব আদবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনীষীবৃন্দের কয়েকটি উক্তি নিম্নে আলোচনা করা হচ্ছে:
০১। হযরত উমর (রা) বলেছেন : “প্রথমে আদব শিক্ষা কর,তারপর বিদ্যা শিক্ষা কর”।
০২। হযরত আলী (রা) বলেছেন : “ প্রত্যেক বস্তুরই একটা মূল্য হয়ে থাকে, মানুষের মূল্য বা মূল্যায়ন হয়ে থাকে তার জ্ঞান ও আদব বিচারে ”।
০৩। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক (র) বলেছেন : “আমি যদি এমন কোন মনীষীর সংবাদ পাই যাঁকে সকল পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জ্ঞানবিদ্যা প্রদান করা হয়েছে ; তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আদব সর্ম্পকে অজ্ঞ-অনভ্যস্থ। তাহলে সেক্ষেত্রে তাঁর মতো মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়াতে কক্ষনো আমার অনুতাপ হবে না। আর যদি কোথাও এমনটি শুনতে পাই যে, অমুক ব্যক্তি আদবপুর্ণ মনীষী তাহলে তেমন কারও সাক্ষাৎ-বঞ্চিত হলে আমি প্রচন্ড দুঃখ পাই।”
০৪। হযরত মুখাল্লাদ ইবন হুসাইন (রা) বলেছেন : “আমরা অধিকহারে হাদীস বর্ণনার তুলনায়, আদবের প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী।”
০৫। ফক্বীহ আবুল্লাইস সমরকান্দী (র) বলেছেন : “ইসলামের পাঁচটি দূর্গ রয়েছে, প্রথমটি হচ্ছে প্রত্যয়পুণর্ বিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইখলাস-নিষ্ঠা, তৃতীয়টি হচ্ছে ফরযসমূহ, চতুর্থটি হচ্ছে পরিপূর্ণ সুন্নাত, আর পঞ্চমটি হচ্ছে অ্াদব বিষয়ে যতœবান হওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ আদব রক্ষার প্রতি সতর্ক ও যতœবান থাকে, শয়তান তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে থাকে। আর যখনই সে আদব-শিষ্টাচার ছেড়ে বসে তখনই শয়তান তাকে সুন্নাত পরিহার করানোর গবেষণায় লেগে যায় ; তারপর পর্যায়ক্রমে ফরয ত্যাগ, নিষ্ঠা ত্যাগ ও দৃঢ়-বিশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত পরিস্থিতি গড়ায়।”
০৬। হযরত আবূ আব্দুল্লাহ বলখী (র) বলেছেন : “একজন মানুষের আদব-শিষ্টাচার অর্জন করা তার বিদ্যা অর্জনের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।”
০৭। হযরত শায়খ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (র) বলেছেন : “আদবহীন ব্যক্তি ¯্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের কাছে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত হয়ে থাকে।”
০৮। হযরত দাতা গঞ্জেবখশ আলী হুজবীরী (র) স্বীয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘কাশফুল- মাহজুব’-এ লিখছেন:“আদব পরিহারকারী ব্যক্তি মুহাম্মাদ (স) এর চরিত্র- আচরণ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে থাকে।”
০৯। হযরত রুয়েম (র) আবূ আবদুল্লাহ ইবনে খাফীফ (র) হতে উদ্ধৃত করেছেন : “হে আমার পুত্র ! স্বীয় আমলকে লবনসম বানিয়ে নাও,আদবকে আটাসম বানিয়ে নাও। অর্থাৎ আদবের প্রতি অধিক যত্নবান হও, যেন আমল ও আদব আধিক্যের প্রশ্নে লবন ও আটার অনুরূপ ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে যায়।”
কবিদের দৃষ্টিতে আদব: আদবের গুরুত্ব শিরোনামে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কাব্য-কবিতার বিরাট সম্ভার বিদ্যমান।
এখানে কেবল উদাহরণস্বরূপ আরবী,ফারসী ও উরদু ভাষা থেকে একটি করে পঙক্তি পেশ করা হচ্ছে: “হে সাথী-বন্ধুগণ! নিজেরা নিজেদের আদব শিক্ষা দাও। তার কারণ, প্রেম-ভালোবাসা, মহব্বত অর্জনের যত পন্থা-পদ্ধতি আছে ত্রা সবই শুধু আদব আর আদবই।”-অর্থাৎ আদব-ভদ্রতা-শালীনতানির্ভর।
“আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আদব-শিষ্টাচার এর তাওফীক কামনা করছি। কেননা আদবহীন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার দয়া-অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হয়।”(রূমী) “হে মন! চুপ থাকো মাহফিল-মজলিসে হৈ-চৈ,শব্দ করা মোটেও ভালো নয়,আদব-ভদ্রতাই প্রেম-ভালোবাসা প্রাপ্তির প্রথম সংকেত।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।