দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এভাবেই সে প্রশান্তি পাবে। পরিশুদ্ধ হবে তার অন্তর। এমন কি এক পর্যায়ে তার ইচ্ছাশক্তি তার নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। তখন সে পুনর্বার অন্যায় অপকর্ম করা থেকে বিরত থাকবে। পূর্বে আরো বলা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের পানাহার করতে হয় না। এটা তাদের বৈশিষ্ট্য। সিয়ামের মাধ্যমে পানাহারকে সংযত করে মানুষ ক্রমান্বয়ে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যকেই গ্রহণ করে। বস্তুতপক্ষে সমস্ত কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নির্দেশগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করে। এক সময় তাতে সে সফলও হয়। তখন যে আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করে। এভাবেই সে এগিয়ে যায় আল্লাহর সান্নিধ্যে এবং এটাই হল মানুষের পরম লক্ষ্য।
হজ্জের শাব্দিক অর্থ সংকল্প করা। এর আরেকটি অর্থ কোন কিছুর উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করা। প্রচলিত অর্থে হজ্জ বলতে কা’বা ঘর তওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ, আরাফাত-মুযদালিফা ও মিনায় অবস্থান করাকে বুঝায়। বস্তুতপক্ষে হজ্জের অর্থ আরো ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্বাবলীর মধ্যে হজ্জের স্থান তৃতীয়। পূর্ণবয়স্ক ও সামর্থ্যবান প্রতিটি মু’মিন মুসলমানের জন্য হজ্জ ফরয। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেককেই তার জীবদ্দশায় একবার মক্কায় যেতে হয়। হজ্জ পালনের মধ্যে দিয়েই সে নিজের অহংবোধকে নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। নিজের সত্তাকে একাকার করে ফেলে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে। আর যাদের হজ্জে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত। কিন্তু এমন কোন মুসলমান কি আছে যে, আল্লাহর ঘর কা’বায় হাজির হবার সামর্থ্য লাভের আশায় অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় না করবে?
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী (৩ ঃ ৯৬)। হযরত আদম (আ) প্রথমে যে ঘর নির্মাণ করেছিলেন, পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম (আ.) কেবলমাত্র তা পুননির্মাণ করেন। কেউ যদি কেবলমাত্র ইবরাহীম (আ.)-এর সময়কালকে হিসাবে আনে, তাহলেও কা’বাই হবে সবচেয়ে পুরানো ঘর। হযরত সুলায়মান (আ.) নির্মিত যেরুজালেমের ইবাদতগাহের চেয়েও কা’বা অধিক পুরাতন। কা’বা ঘরের চেয়ে পুরান কোন ইবাদতখানা দ্বিতীয়টি আর নেই।
এখানে সংক্ষেপে হজ্জের আচার-অনুষ্ঠানগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। পবিত্র মক্কার সীমানায় মীকাত আসার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যদিনের পোশাক খুলে ফেলতে হয়। তাকে পরিধান করতে হয় নির্ধারিত ইহরামের দুখ- কাপড় যা সিলাইবিহীন। একখ- কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত এবং অন্যটি কাঁধ আবৃত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ পোশাক কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য। মহিলাদের জন্য ভিন্ন পোশাক। এ সময় পুরুষের মাথাকে অনাবৃত অবস্থায় রাখতে হয়। তাছাড়া হজ্জের দিনগুলোতে সে নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
মক্কার অদূরে একটি স্থানের নাম আরাফাত। ইহরামের পোশাক পরিহিত অবস্থায় তাকে সেখানে যেতে হয়। সেখানে সে দিনটি অতিবাহিত করে গভীর ধ্যান-মগ্নতার মধ্য দিয়ে। দিবাবসানে সে আরাফাতের ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তন করে। রাতটি অতিবাহিত করে মুযদালিফায়। পরদিন প্রত্যুষে সে পৌঁছে যায় মক্কার সীমান্তবর্তী অঞ্চল মিনায়। তাকে এখানে তিনদিন থাকতে হয়। প্রতিদিন সকালে সে শয়তানকে লক্ষ্য করে কঙ্কর ছোড়ে, একটি পশু কুরবানী দেয়। এক সময়ে সে ক্ষণিকের জন্য চলে আসে কা’বায়। এখানে কা’বার চতুষ্পার্শ্বে চক্কর দিয়ে সাতবার তওয়াফ করে এবং কা’বা ঘরের পার্শ্বে অবস্থিত সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাত বার দৌড়ে সাঈ পালন করে।
বস্তুতপক্ষে এ ধরনের আচার-অনুষ্ঠান প্রতিপালনের একটি প্রতীক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। বেহেশত হতে বের হয়ে আসার পর হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর শুরু হয় একে অপরকে অনুসন্ধানের পালা। অবশেষে আল্লাহর অসীম রহমতে তাঁরা মিলিত হলেন আরাফাতের ময়দানে। হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়ার বংশধরগণ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আরাফাতের ময়দানে এসে সমবেত হয়। নিজেদের অস্তিত্ব ও সত্তাকে ভুলে গিয়ে আল্লাহকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। এভাবেই সে অতীতের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আগামী দিনগুলোর জন্য তাঁর হিদায়েত ও সাহায্য কামনা করে।
শয়তানের প্রতি কংকর নিক্ষেপ করা প্রসঙ্গে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ঘোষণাটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি দুনিয়ার যে কোন জিনিসের চাইতে আল্লাহকে বেশি ভালবাসেন। তাঁর এ দাবি যে সত্য তা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁকে প্রাণ দিয়ে পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করতে বললেন। ঠিক তখনই শয়তান এসে সেখানে হাযির হয় এবং ইসমাঈলকে কুরবানী দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। প্রতিবারই ইবরাহীম (আ.) শয়তানকে তাড়িয়ে দেন এবং তাকে লক্ষ্য করে কংকর ছোড়েন। অতঃপর শয়তান বিবি হাজেরার কাছে যায়। সবশেষে যায় ইসমাঈল (আ.)-এর কাছে। তাঁদেরকেও ঠিক একইভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই শয়তানকে তাড়া করেন। প্রতীকী আচরণ হিসাবে এখনো আমরা এর পুনরাবৃত্তি করে থাকি। এভাবেই মনের শয়তানী ও কুপ্রবৃত্তিগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করি।
আল্লাহর ঘর কা’বায় হাজির হওয়ার ঘটনাটি ব্যাখ্যা করে বলা অনাবশ্যক। আনুগত্য প্রকাশের নজীর হিসাবেই একজন মু’মিন কা’বা ঘরে যায়। তখন তার মধ্যে বিরাজ করতে থাকে পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং বিনম্রতা। তাছাড়া যে জিনিসের প্রতি কারো অনুরাগ থাকে, যাকে কেউ অন্তর দিয়ে ভালবাসে, যতœ করে, তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার নজীর হিসাবে তার চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে। এ রেওয়াজটি সুদৃঢ় অতীতকাল থেকে চালু রয়েছে। অনুরূপভাবে একজন মু’মিন কা’বা ঘরে এসে নির্দিষ্ট নিয়মে কা’বা ঘর তাওয়াফ করে।
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে ঘিরে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। আর সে কারণেই বিষয়টির উপর সামান্য আলোকপাত করা আবশ্যক। এটা কোন জাদুকরী বা মহাকাশ থেকে আসা বিশেষ পাথর নয়। বরং সত্যিকার অর্থেই এটা একটা কালো পাথর। পাথরটির একটি ব্যবহারিক উপকারিতা রয়েছে। কালো হওয়াতে পাথরটি দূর থেকে সহজেই দৃশ্যমান এবং কোন স্থান থেকে তাওয়াফ শুরু করতে হবে কালো পাথর তা বলে দেয়। তাছাড়া পাথরটিকে কেউ পূজা করে না অথবা মুসলমানরা এটাকে লক্ষ্য করে সেজদাও করে না। বরং তারা সেজদায় যায় কা’বা ঘরকে লক্ষ্য করে এবং সেটা কা’বা ঘরের যে কোন দিক বা প্রান্ত থেকে হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ৩৩৮ হিজরী মোতাবেক ৯৩০ সালে কারামতীরা মক্কা নগরীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সে সময়ে তারা কালো পাথরটিও স্বদেশে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ২১ বছর পাথরটিকে নিজেদের আয়ত্তে রাখে। সে সময়েও মুসলমানরা কা’বা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়াত। এমনকি কখনো যদি কা’বা ঘরের সংস্কার অথবা কোন কারণে নতুনভাবে আরেকটি ঘর নির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমান ঘরটি ভেঙে ফেলতে হয়, তখনো মুসলমানরা ঐ স্থানটির দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। কালো পাথরসহ কা’বা ঘরটি সেখানে আছে কি নেইÑসে বিষয়টি গৌণ হিসাবেই থেকে যাবে।
সাফা-মারওয়ার পাদদেশ দিয়ে ৭ বার দৌড়ানোর যোগসূত্র রয়েছে বিবি হাজেরার সঙ্গে। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং দুধের শিশু ইসমাঈল (আ.)-কে মক্কার জনমানব শূন্য একটি নির্জন স্থানে রেখে আসেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের খাবার পানি নিঃশেষ হয়ে যায়। মাতৃস্নেহ মা হাজেরাকে অস্থির চঞ্চল করে তোলে। পিপাসায় কাতর শিশুর জন্য এক ফোঁটা পানির অন্বেষণে তিনি ছুটাছুটি করতে থাকেন। অতঃপর নির্গত হল যমযম। মা হাজেরা যে স্থান বরাবর পানির জন্য ছুটাছুটি করেছিলেন, মুসলমানরা এখনো সেখানে গিয়ে এর পুনরাবৃত্তি করে থাকেন। এটা তারা করে থাকেন মাতৃ-ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া জানানোর উদ্দেশ্যে।
হজ্জের সামাজিক তাৎপর্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হজ্জ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। বর্ণ ভাষা গোত্র স্থান ও আভিজাত্যের তারতম্যের কথা ভুলে গিয়ে সকল মু’মিন মুসলমান কা’বা ঘরে আসার জন্য তীব্র তাকিদ অনুভব করে। এখানে তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয় আন্তরিক ও সাম্যের ভিত্তিতে। নির্জন মরুভূমিতে তাঁরা ছাউনি ফেলে দিন যাপন করেন এবং হজ্জের আরকান-আহকাম পালন করেন সমবেতভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে। এমনিভাবে তাঁরা অতিবাহিত করেন কয়েকটি দিন। এ সময়ের মধ্যে তারা নির্ধারিত নিয়মে কখনো সফরে থাকেন কখনো বিশ্রাম করেন, আবার তাঁবুর মধ্যে অথবা খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করেন। বস্তুতপক্ষে এর ব্যাপকতা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে মূলত আল্লাহর সৈনিকগণ সুশৃঙ্খল জীবনের প্রশিক্ষণ লাভ করে।
নবী করীম (সা.) ইন্তেকালের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে হজ্জ পালন করেন। সে সময়ে তিনি জাবালুর রহমতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ইসলামের ইতিহাসে এই ভাষণ মুক্তি সনদ হিসেবে পরিচিত। সে বছর আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১,৪০,০০০ লোক হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আসেন। রাসূলে করীম (সা.)-এর ভাষণ শোনার জন্য তাঁরা সমবেত হন জাবালুর রহমতের পাদদেশে। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জগদ্বাসীকে ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন যে, (ক) এক আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কোন মূর্তি বা বস্তু তাঁর প্রতীক হতে পারে না। (খ) সকল মানুষ সমান। ধর্ম বা কৌলিন্যের কারণে মানুষের মধ্যে কোন রকম তারতম্য বা ভেদাভেদ হতে পারে না। কেউ দাবি করতে পারে না একজনের উপর আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবলমাত্র ব্যক্তির আল্লাহ ভীতি এবং আমলে সালেহ-এর নিরিখে। (গ) জীবন, সম্পদ এবং সম্মানের ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষের রয়েছে মৌলিক অধিকার। (ঘ) সুদী কারবারকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করলেন। (ঙ) রহিত করলেন বংশগত বিরোধ এবং মানুষের তৈরি মতলবী বিচার ব্যবস্থাকে। (চ) নারী জাতির সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন। (ছ) সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে অবিরত বণ্টন এবং হাত বদল হতে হবে। সে জন্য উত্তরাধিকার আইন ও উইল সংক্রান্ত বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে। (জ) তিনি আরো ঘোষণা দিলেন যে, আমাদের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই আল্লাহর কালাম আল-কুরআনই হবে সকল আইনের উৎস।
জানা যায় যে, হজ্জের ব্যাপারে জাহেলিয়াত যুগের কিছু আচার-অনুষ্ঠান ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম যামানা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যেমনÑবিশাল জনসমাবেশ উপলক্ষে এ সময়ে একটি বাৎসরিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হত। এ সম্মেলনে কবিরা তাদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করত। অনলবর্ষী বক্তারা উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিয়ে তাঁদের মেধা প্রকাশ করত। পেশাদার কুস্তিগীরেরা দর্শকদের মাতিয়ে রাখত। আবার ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসত হরেক রকমের বিক্রয় সামগ্রী। খলীফা হযরত উমর (রা.)-এর আমলে এ সমাবেশ প্রশাসনিক গুরুত্ব লাভ করে। তিনি এ সমাবেশকে ব্যবহার করেন একটি আপীল কোর্ট হিসাবে। এ সময়ে জনসাধারণ গভর্ণর ও সেনাপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলতে পারত। অভিমত পেশ করতে পারত সরকারের নতুন নতুন প্রকল্প সম্পর্কে।
পরিশেষে আবারো স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইসলামে জাগতিক এবং ধর্মীয় জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো সমানভাবে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এগুলোর মধ্যে রয়েছে চমৎকার সঙ্গতি ও সংযোগ।
সাধারণ অর্থে যাকাত বলতে মওজুদ অর্থ বা সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে বছরান্তে দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করাকে বুঝায়। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি ফসল, ব্যবসা-বাণিজ্যের পুঁজি, গৃহপালিত পশু, মওজুদ অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদের উপর ধার্যকৃত অর্থ। গোড়ার দিকে যাকাত হিসাবে পরিশোধযোগ্য সমস্ত অর্থ সরাসরি সরকারী তহবিলে জমা দিতে হত। কিন্তু খলীফা উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মওজুদ অর্থের উপর যে যাকাত হয় তা মুসলমানরা নিজেরাই ব্যয় করতে পারবে। তবে কুরআন মজীদে যে সমস্ত খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন রয়েছে, এ ব্যয় কেবলমাত্র সে সমস্ত খাতে হতে হবে।
কুরআন মজীদে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, সম্পদ হল মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং মৌলিক উপাদান। ইসলামে যাকাত প্রদান করাকে ঈমানের একটি অঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামায, রোযা ও হজের ন্যায় যাকাতকেও দেয়া হয়েছে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মর্যাদা। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র প্রধানের আরাম আয়েশ বা শান-শওকতের জন্য কেউ যাকাত দেয় না। বরং ব্যক্তির উপর সমাজের বিশেষ করে অভাবগ্রস্ত মানুষের যে অধিকার রয়েছে তারই অংশ হিসেবে সে যাকাত দেয়। এভাবেই সে নিজের আত্মাকে পবিত্র এবং উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে বিবেচনা করলেও এটাই যাকাতের উদ্দেশ্য।
নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, “রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসক হল মানুষের খাদেম”। আর নবীজী ছিলেন মুসলমানদের আধ্যাত্মিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। নবীজীর এ উক্তির যথার্থতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, “মুসলমানরা ট্যাক্স হিসেবে যে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিবে তা তাঁর নিজেরও বংশের কোন লোকদের জন্য নিষিদ্ধ।” আর এটা তো জানা কথা যে রাষ্ট্রপ্রধান যদি ন্যায় নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান হয়, তাহলে অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও তাদের কাজ-কর্মের ব্যাপারে অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে থাকে।
রাসূলে করীম (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান নাগরিকদের যাকাত ব্যতীত আর কোন কর দিতে হত না। উল্লেখ্য যে, যাকাতের সঙ্গে দান-খয়রাতের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মুসলমানগণকে নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং বাধ্যতামূলকভাবে যে যাকাত পরিশোধ করতে হত সেটাই বিবেচিত হত রাজস্ব হিসাবে। রাসূলে করীম (সা.) যাকাতকে একটি ধর্মীয় দায়িত্ব বা ইবাদত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। একজন মুসলমানের অন্তরে যাকাত আদায়ের ব্যাপারে নিষ্ঠা এবং আগ্রহ সৃষ্টি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। তা ছাড়া এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নামায, রোযা ও হজ্জের মতো যাকাতও আল্লাহর প্রদত্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।