দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুফতী পিয়ার মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, বিশ^ জাহানের প্রতিপালক, পরম দয়ালু আল্লাহতায়ালা নিজেই যখন এর প্রতিদান দিবেন, তখন কি পরিমাণ দিবেন? এর ব্যাখ্যায় উলামায়ে কিরাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে যে পুরস্কার দিবেন তা মাপা হবে না, ওজন করা হবে না। দিবেন বিনা হিসাবে। রোজা ও অন্যান্য আমলের মাঝে এই ব্যবধান হলো কেন? এর জবাবে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেছেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে সকল আমলই হয়ে থাকে আল্লাহর জন্য, তাঁরই সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায়। তথাপি অন্যান্য সকল ইবাদতের কাঠামোগত ক্রিয়াকলাপ, আকার-আকৃতি ও পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশের পাশাপাশি রিয়া, লোক দেখানো ও নফসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগও বিদ্যমান থাকে। তার অনভূতির আড়ালেও তা লুকিয়ে থাকতে পারে। নিজে অনুভব করতে না পারলেও তার ভিতরে অবচেতনভাবেও তা বিদ্যমান থাকতে পারে। পক্ষান্তরে রোজার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। রোজা কাঠামোগত, আকার-আকৃতি ও নিয়ম-পদ্ধতিতে এমন যে, ‘রেযায়ে মাওলা’ ব্যতীত রোজাদারের অন্য কোন স্বাদ গ্রহণের বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে না। নিজে মুখে প্রকাশ না করলে সর্বজ্ঞ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট তা প্রকাশ হয় না। এ কারণেই রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের মাঝে এই ব্যবধান।
রোজা পালনকারীর ব্যাপারে যেভাবে আল্লাহর অফুরন্ত ও অবারিত নিয়ামত ও পুরস্কারের ওয়াদা বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সেভাবে ইচ্ছাকৃত রোজা পরিত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীর ব্যাপারেও বর্ণিত হয়েছে কঠোর ও চূড়ান্ত শাস্তিবাণী। সাহাবী আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাকে (সা.) বলতে শুনেছি, আমি একদা ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম, আমার নিকট দুইজন ব্যক্তি এলেন। তারা আমার বাহু দুটি ধরে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। তারপর বলেলন, আপনি এই পাহাড়ে উঠুন। আমি বললাম, এই পাহাড়ে তো আমি উঠতে পারব না। তারা বলেলন, আমরা আপনাকে উঠতে সহজ করে দিব। এরপর আমি পাহাড়ে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতল স্থানে পৌঁছলাম, তখন হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তারা বলেলন, জাহান্নামীদের আর্তনাদ। এরপর তারা আমাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললেন। অকস্মাৎ এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের মাংসপেশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছে আর তা থেকে রক্ত ঝরছে অনবরত। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা? তারা উত্তর দিলেন, এরা ওই সমস্ত লোক যারা ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বেই রোজা ভেঙে ফেলে। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ১৯৮৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৭৪৪৮; তাবারানী, হাদিস : ৭৬৬৬; সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদিস : ৩২৮৬) রমযানুল মুবারকের রোজা ইচ্ছাকৃত ও বিনা ওযরে ভেঙে ফেললে বা না রাখলে বান্দা গুনাহগার ও জাহান্নামের শাস্তির উপযুক্ত হয় কেবল তাই নয়; ওই এক রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখলেও রমজানের এক রোজার যে ফজিলত, বরকত ও কল্যাণ তা কখনও লাভ করতে পারবে না এবং কোনভাবেই এর যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না।
এ মর্মে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) “যে ব্যক্তি সফর ও কোন অসুস্থতা ব্যতীত ইচ্ছাকৃত একটি রোজাও ভাঙবে, সে আমৃত্য রোজা রাখলেও সে রোজার যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৬/১৩৫; ইবনে মাজা : ১২০; বুখারি : ১/২৫৯) এ ব্যাপারে সাহাবী হযরত আলী (রা.) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে আজীবন রোজা রাখলেও সেই রোজার হক আদায় করতে পারবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৬/৩২৫; ইবনে মাজা : ১২০; বুখারি : ১/২৫৯) রোজার জাগতিক উপকারিতাও নেহায়াত কম নয়। রোজার মাধ্যমে মানুষের ভিতর সবর, শকর, হামর্দদী বা সহমর্মীতার মতো মহৎ গুণাবলী সৃষ্টি হয়। লোভ-লালসা, হিংস্রতার মত ক্ষতিকারক স্বভাবগুলো দূর হয়ে যায়। এছাড়া বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানও বলে শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা ব্যাপক ও প্রশংসনীয়। (মসায়েলে রফআত কাসেমী : ২/২৫-২৬, রোজা অধ্যায়)
এই রোজা মূলত অসীম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ হতে মুমিন বান্দার জন্য এক বিশেষ উপঢৌকন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উত্তম উপায়। পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। আত্মশুদ্ধির কার্যকর প্রক্রিয়া। ইবাদত-বন্দেগী কবুল হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিৎ, শরিয়ত বর্ণিত যথাযথ পন্থায় রোজা পালন করে রোজার ফাযায়েল ও ফাওয়ায়েদ অর্জনে সদা তৎপর থাকা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক করুন। আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।