Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

প্রেম-বিয়ে বশ করা, গোপন রোগের চিকিৎসার নামে ভন্ড কবিরাজি করত সে

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০২২, ২:৩৫ পিএম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাম্পত্য জীবনের সমস্যা, বিয়ে না হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, এমনকি কাউকে বশ করার তাবিজ- সবই পাওয়া যেত কবিরাজ ওয়াস কুরুনীর কাছে। প্রায় ৩ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল এই ভন্ড কবিরাজ। অর্ধশতাধিক মানুষের কাছ থেকে লুটে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মংগলবার মুন্সীগঞ্জ থেকে জেলার লৌহজং এলাকা থেকে এই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব ৩। সংস্থাটি বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই তিনি এ প্রতারণা করতো। তার ২০ থেকে ২২ জনের দল রয়েছে। এরাই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট ছড়িয়ে দিত এবং আগ্রহীদের প্রতারণার শিকার বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মোটা অংকের টাকা ও স্বর্ণলংকার হাতিয়ে নিতো।


এসময় ১ পাগড়ী, ২টি গলার হার, ৫টি গলার চেইন, ২জোড়া কানের দুল, ১টি মাথার টিকলি, ১ টি মাথার চুল, ৫টি সাপ, ৪ টি বিভিন্ন মন্ত্র লেখা কাগজ, ১টি তাবিজের খোসা, ২ টি বনাজি কাঠের লাঠি, ২ টি হরিনের চামড়া, বিভিন্ন ধরনের বনাজি গাছ গাছালি, ৪ টি সিংগা, ২ টি বড় কড়ি, ৫ টি ছোট কড়ি, ৩ টি হাড়ের টুকরা, ১ টি মরিয়ম ফুল এবং ১ টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।

 

বুধবার দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলি র‍্যাব ৩ কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ওয়াস কুরুনী র‍্যাবকে জানায়, তার কবিরাজ আলী আশরাফ, তান্ত্রিক কবিরাজ এবং হুমায়ুন আহমেদ নামে তিনটি বেনামী ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে। এসব একাউন্টগুলোতে সে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিরাচরিত সমস্যা যেমন, উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের গোপন রোগের চিকিৎসা, দাম্পত্য জীবনের সমস্যা, বিয়ে না হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকর না পাওয়া, জমি-জমার ঝামেলা, কাউকে বশ করার প্রবণতা, বাণ মারার শক্তিশালী মন্ত্র, মামলায় জয়ী হওয়ার মন্ত্র, বিয়ের প্রস্তাব আসার তাবিজ, প্রেম সফল করার তাবিজ, বিয়ে বন্ধ করার তাবিজ, মানুষকে পাগল করার তাবিজ ইত্যাদি শিরোনামে বিভিন্ন পোষ্ট করে থাকে।

 

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, তার ২০/২২ জন নির্বাচিত এজেন্ট রয়েছে। যাদের কাজ হল এসব পোস্ট বারবার শেয়ারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া এবং আগ্রহীদের প্রতারণার শিকার বানিয়ে তাদের কাছ থেকে কৌশলে মোটা অংকের টাকা এবং হাদিয়া হিসেবে স্বর্ণলংকার হাতিয়ে নেয়া। সে এবং তার চক্রটি মিলে ওয়াস কুরুনী এর বিকাশ নম্বরে অর্থের লেনদেন করে থাকে এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিকটিমদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেয়।

 

এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের (১৫-২০ বছর বয়সী) টার্গেট করে তার নিয়োগ করা মহিলা এজেন্টরা বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় এবং মহিলা মাদ্রাসায় গিয়ে অপেক্ষমান অভিভাবকদের সাথে মিশে যায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন মেয়েদের টার্গেট করে। অভিভাবক পরিচয়ে তারা স্কুল পড়ুয়া অল্পবয়সী মেয়েদের বিভিন্ন গোপন সমস্যা নিয়ে কথা বলে এবং সে সমস্যাগুলো কবিরাজী চিকিৎসা ও তাবিজ গ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে তাদেরকে প্রলুব্ধ করে।


লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ, তাদের প্রলোভনে পড়ে ভিকটিমরা তাদের কাছে জমানো টাকা, অলংকার এবং পারিবারিক যেকোন মূল্যবান সম্পদের বিনিময়ে হলেও সমস্যা সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তাদেরকে প্রলুব্ধ করার পর তার সহযোগীরা কবিরাজ ওয়াস কুরুনীর মোবাইল নম্বর দিত। তখন সে তাদের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের কাছ থেকে অর্থ এবং স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিত।

 

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার ওয়াস কুরুনী আরও জানায়, টার্গেটকৃত নারী ও পুরুষ ভিকটিমদের সাথে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমে চ্যাটিং ও ভয়েস কলের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাদেরকে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়। প্রাথমিকভাবে সে জ্বীন চালানের মাধ্যমে ঔষধ দেয়া এবং গায়েবী চিকিৎসা শুরু করার জন্য দূর্লভ কিছু উপাদান যেমন, কচি কবুতরের রক্ত, ইদুরের মাংস, বানরের লোম, বাদুরের পা, গভীর রাতে শ্মশানঘাট থেকে মাটির কলসিতে পানি সংগ্রহ করা সহ দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করতে বলত।

 

তিনি আরও বলেন, ভিকটিমরা এসব জিনিস তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয় বলে জানালে তখন সে এসব জিনিস সংগ্রহ করার বদলে মোটা অংকের টাকা দাবী করত। তখন ভিকটিমরা বাধ্য হয়ে তাকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দিত। তার চিকিৎসা দ্বারা কাজ না হওয়ার বিষয়ে রোগীরা অভিযোগ দিলে বা আরও ত্বরান্বিত চিকিৎসা চাইলে জ্বীনের মাধ্যমে দ্রুত সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য জ্বীনকে উপহার দেয়ার কথা বলে সে ভিকটিমদের কাছ থেকে কৌশলে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তার কাছে পাঠাতে বলত।

 


র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক বলেন, ভিকটিমদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সে কবিরাজীর বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে ভিকটিমদের কাছে পাঠাত। তার কাছে থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইলে এরকম অসংখ্য ছবি এবং ভিডিও পাওয়া যায়। কেউ তার প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ প্রকাশ করলে দুষ্ট জ্বীন দ্বারা নিয়মিতভাবে তাদেরকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মূখীন হতে হবে বলে হুমকি দিত। এভাবে সে ভিকটিমদের গায়েবি ভয় ভীতি দেখিয়ে ধাপে ধাপে তাদের থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিত।

 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, কোন ভিকটিমের সাথে দেখা করতে চাইত না। নারী ভিকটিমদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায়ের জন্য সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখাত। তখন ভিকটিমরা নিরুপায় হয়ে তার চাহিদা মত অর্থ দিতে বাধ্য হত। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সে এবং তার পুরো চক্রটি মিলে গত ৩ বছরে অর্ধশতাধিক লোকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছে।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব স্বর্ণালংকার ও আত্মসাৎকৃত অর্থ দিয়ে সে লৌহজং এলাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরী করে। অর্থ এবং স্বর্ণালংকার গ্রহণের পর ভিকটিমদের ফোন নম্বর সে এবং তার এজেন্টরা মোবাইল থেকে ব্লক করে দেয়, যেন ভিকটিমরা কোনভাবেই তাদের সাথে আর যোগাযোগ করতে না পারে। এরপর ভুক্তভোগীরা তাদের দেয়া অর্থ এবং অলংকার ফেরত পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।


ওয়াস কুরুনী মাদ্রাসা থেকে হেফজ খানা পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। সে ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে। প্রথমে সে যাত্রীবাহি বাসে তাবিজ বিক্রি ও বশিভুত করনের বই বিক্রি করত বলেও জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্রেফতার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ