পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগোষ্ঠির নাম রোহিঙ্গা। মূলত এরাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মুসলমান। আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকা ছিল প্রধান। অথচ, দশকের পর দশক চলে আসা বৈষম্যের কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা আজ উদ্ধাস্ত ও বন্ধুহীন। বিশ্বের বুকে তারাই সবচেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি। ১৭৮৫ সালে বর্মিরাজ বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের মধ্য দিয়েই মূলত রোহিঙ্গাদের নিগৃহীত জীবনের সূচনা হয়। বিশেষ করে, ১৯৩৭ সালের পর ব্রিটিশের বিদায়লগ্ন থেকে তাদের উপর মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় মগদের নির্যাতনের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৪২ সালে জাপান বার্মা দখল করে ব্রিটিশমুক্ত করলে স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠি জাপানি বাহিনীর সহায়তায় আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়, যা ’৪২ এর গণহত্যা নামে কুখ্যাত। এই নির্মম গণহত্যায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং পাঁচ লক্ষাধিক প্রাণভয়ে বাংলার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ বাংলার কয়েকটি অঞ্চলে চলে আসে। ১৯৫৬ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানরা স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে মগ জনগোষ্ঠী দ্বারা পুনরায় নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৭৩ সালে উত্তর আরাকানে Major Aung than operation, ১৯৭৪ সালের Sabe operation, ১৯৭৮ সালে King Dragon operation, ১৯৯০-৯১ সালে Prithoya operation, এর মাধ্যমে বার্মার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের খুন, ধর্ষণ, পৈতৃক বসতভিটায় আগুন দেয়ায় শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতার পর বার্মার উন সরকার বার্মার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠিকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে একমত ছিল। ১৯৪৭ সালে ‘প্যান লং’ চুক্তি মোতাবেক এই জনগোষ্ঠিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জেনারেল নে-উইন গণতান্ত্রিক উনু সরকারকে একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করায় এই প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রোহিঙ্গাসহ বার্মার সংখ্যালঘু জাতিসমূহের সকল প্রকার সাংবিধানিক অধিকার বাতিল হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে Burma Broadcasting Service থেকে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানাদি প্রচার বন্ধ করে দেয়। ১৯৬৬ সালে সমস্ত বেসরকারি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে রাজধানী রেঙ্গুনে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের মজুতকৃত খাদ্য শস্য জোরপূর্বক রেঙ্গুনে পাঠানো হয়। ফলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে চলে আসে। মিয়ানমারে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ এবং সরকারিভাবে স্বীকৃতি ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির দেশ। কিন্তু আশ্চর্য হলো সামরিক সরকার ১৯৮২ সালে বার্মার স্টেট-ল এ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল (Barma State Law and order restoration council) নামক বৈষম্যমূলক আইন বাস্তবায়ন করে রোহিঙ্গা মুসলমান ব্যতিত অন্য সব বর্ণের লোককে নাগরিকত্বের প্রত্যায়নপত্র প্রদান করে।
২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধ ও আরাকানি মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। রাখাইন এক মহিলাকে হত্যার অভিযোগে রাখাইনরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এই সহিংসতায় বহু নিহত এবং ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। রোহিঙ্গারা এই অত্যাচার সইতে না পেরে পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশে ২৮,০০০ হাজার শরণার্থী ও অবৈধভাবে ৩ থেকে ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে।
২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর আরাকানের সীমান্ত ফাঁড়িতে আকস্মিক সন্ত্রাসী হামলায় ৯ জন পুলিশ নিহত হয়। কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই সন্দেহজনকভাবে এই হামলায় দায় রোহিঙ্গাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর অমানবিক দমন-নিপীড়ন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। তারা গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। নির্বিচারে হত্যা করা হয় নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমানকে। বাড়ি থেকে মহিলাদের তুলে নিয়ে গণধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়।
২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে সর্বস্ব হারিয়ে শুধু জীবনটা নিয়ে তারা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত এই মানুষগুলোকে দেখে পাষাণও গলে গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার নিছক মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল। যদি বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় না দিতো তাহলে হয়তো প্রায় ১১ লাখ সহায়সম্বলহীন বাস্তুহারা পলায়নপর অবালবৃদ্ধবনিতা রোহিঙ্গার সলিলসমাধি হতো নাফ নদীতে। অথবা কুকুর বিড়ালের মতো মরতে হতো পশ্চাদ্ধাবমান নেকড়ে সাদৃশ্য বার্মিজ সৈন্যদের গুলিতে।
১৯৪২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ সরকার এসব পলায়নপর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে শুধুমাত্র মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই ১৯৫৮, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৯২ সালে মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের একাংশকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ২০১৬ সালের দাঙ্গায় পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনার প্রেক্ষিতে মাত্র ৩,৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। অথচ সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জন্য এ সংখ্যা অতি নগণ্য নয় কী? তাহলে বাকীদের ভাগ্যে কী আছে? উপরন্তু মিয়ানমার সরকার এসব রোহিঙ্গার নাগরিকত্বের ব্যাপারে কোন স্পষ্ট মতামত দেয়নি। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায়নি। নাগরিকত্বের প্রশ্নে তা বাতিল করা হয়েছে। এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে আশ্রিত প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেতারা বলেছেন, তাদের ৫ দফা দাবি পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে না। রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো যথা- ক. নাগরিকত্ব প্রদান, খ. ক্ষতিপূরণ, গ. মিয়ানমারে অবাধ চলাফেরার অধিকার, ঘ. গণহত্যায় জড়িতদের বিচার এবং ঙ. পৈতৃক বাসভূমিতে নির্বিঘ্নে বসবাস করার অধিকার। উপর্যুক্ত দাবিগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ঠ প্রতিয়মান হয় যে, এ দাবিগুলোর সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংশ্লিষ্ঠতা নেই। এটা নিছক মিয়ানমার সরকারের নিজস্ব ব্যাপার। তাই রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে পারবে কেবলই মিয়ানমার সরকারই। তাকেই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা দুর্বহ বোঝা। এই বোঝা যত দ্রুত নামবে ততই তার মঙ্গল। ভাগ্য বিড়ম্বিত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বিশ্ববাসীকে সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।