Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সউদী বিনিয়োগ প্রসঙ্গ

সামিনা আক্তার | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০১ এএম

চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং মহামারী করোনার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরব বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের কাছে অন্তত ১২টি খাতে সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এ খাতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সহজ শর্তে বিনিয়োগ ও জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিটেন্স সংগ্রহের জন্য সরকার নতুন জনশক্তি রপ্তানি ও পণ্য রপ্তানিতে আগ্রহী। চলতি মাসের শেষের দিকে সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) বৈঠক ডাকা হয়েছে।
ওই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে সৌদি আরব জানতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে কী ধরনের সহযোগিতা চায়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জেসি বৈঠকের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করবে।
বারবার লোডশেডিং এবং সব ধরনের জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব মুদ্রাস্ফীতিতে লক্ষণীয়। পাশাপাশি সিংহভাগ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন স্টেকহোল্ডাররা। বাংলাদেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশেরও বেশি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আহরণ করা হচ্ছে। কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত বেশিরভাগ সার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে চাপে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ডলার সংকট ও সব ধরনের জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে লোডশেডিং বাড়ছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা অত্যন্ত ইতিবাচক।
আগামী ৩০-৩১ অক্টোবর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য ১৪তম জেসি বৈঠকে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। সভায় যোগদানের আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইআরডি বেশ কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে।
এসব বৈঠকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কাছ থেকে আরও ১২টি খাতে সহযোগিতা চাওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও কনস্যুলার, বেসরকারি বিমান চলাচল, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক, বিনিয়োগ, আবুধাবি উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত, সামুদ্রিক পরিবেশ. উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা খাতে সহযোগিতা এবং মানবিক ও দাতব্য সহায়তা অন্যতম।
সৌদি আরব ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, মিশর ও তুরস্কের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর এসব দেশকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে। এছাড়া সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যপ্রাচ্য শাখা-১ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য জেসি বৈঠকেও এ বিষয়ে একটি রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে। মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) একটি পৃথক কর্মসূচি রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বিশেষ করে প্রধান অবকাঠামো, তথ্য প্রযুক্তি, যোগাযোগ, কৃষি, বিদ্যুৎও জ্বালানি, চিকিৎসা খাতে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের উদ্যোক্তারা চাইলে সেসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নিতে পারে। আরব বিশ্বে পেশাদার, দক্ষ, আধা-দক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তির এখনও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চাইলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল জনশক্তি নিতে পারে। তিনি বলেন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। চলমান সংকট মোকাবেলায় সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের সহযোগিতা নেবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশটি বছরে ৬.৫ মিলিয়ন টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এর মধ্যে বছরে ৪ মিলিয়ন টন ডিজেল আমদানি করা হয়। দেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশের বেশি যানবাহন জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪ শতাংশ জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। এসব জ্বালানির জন্য সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানিগুলো হলো সৌদি আরবের সৌদি আরবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো), সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এডিএনওসি), কুয়েতের কুয়েত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (কেপিসি), পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিসিএল) মালয়েশিয়ার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমিরাত জাতীয় তেল। কোম্পানি (ইঙ্ক), চীনের পেট্রোচায়না (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড এবং ইউনিপেক (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকু (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড, ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল)।
এর আগে ২০১৯ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে দুটি চুক্তি ও চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব চুক্তি হয়। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। এতে উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলমান সংকট দূর হবে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যেরও প্রচুর সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি আরামকো ইতোমধ্যে তেল শোধনাগার নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে খরচ হবে ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি ফার্ম ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন এলএলসি বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। কোম্পানিটি ৭টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী এবং গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রায় ১.৬৮৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ এই মুহূর্তে জরুরি। দেশের সঙ্গে যে কোনো ফোরামের আলোচনায় এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সউদী বিনিয়োগ প্রসঙ্গ
আরও পড়ুন