পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের একটি স্বভাব হলো, আমরা দেয়ালের লিখন পড়ি না। এই কথাটাকেই একটু ঘুরিয়ে মাও সেতুং বলেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো এই যে, আমরা কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। যদি আমরা বেশি দূরে নয়, পাকিস্তানের ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ৫১ বছরের ইতিহাস ভালোভাবে পাঠ করি, তাহলে এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হবো যা বাংলাদেশে এখন ঘটছে। বেশি পেছনে যেতে হবে না। প্রায় ২০ বছর আগে মাগুরায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন ক্ষমতায় ছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছিলেন সাবেক বিচারপতি আব্দুর রউফ। আর বিরোধীদলে ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ঐ উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রউফ নিজেই নির্বাচন বর্জন করেন। প্রায় ২০ বছর পর প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধা-৫ উপ নির্বাচনে। এই উপনির্বাচনে ব্যাপক ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল তার সমস্ত সদস্যকে নিয়ে সর্ব সম্মতিক্রমে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেন। ভোট গ্রহণ বন্ধ করার আগে পর্যায়ক্রমে ৫০টি ভোট কেন্দ্রে চরম অনিয়ম লক্ষ্য করায় ঐ ৫০টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করেন। পাকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসে একটি নির্বাচনী এলাকার ভোট গ্রহণ বন্ধ করার কোনো নজির পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কে বিগত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, এমনকি সরকারপন্থী বলে কথিত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন পত্রিকাতেও এসব অনিয়ম এবং ভোট ডাকাতির খবর নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। একজন আওয়ামী লীগার শিল্পপতির মালিকানাধীন বাংলা দৈনিকটিতে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে,‘বুথে ডাকাত ঠেকাতে না পেরে ভোট বাতিল।’ ঐ রিপোর্টে এবং অন্যান্য পত্রিকার রিপোর্টে ভোট ডাকাতির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে যে, ভোটদানের গোপন কক্ষে জেনুইন ভোটার ঢুকে দেখেন যে, আরও দুই-এক ব্যক্তি আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। তারাই নির্দেশ দিচ্ছেন, নৌকায় টিপ দিতে হবে।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল একটি ভালো কাজ করেছিলেন। তিনি আগে ভাগেই বিভিন্ন কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলেন। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তিনি ঢাকা থেকেই গাইবান্ধার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের ভোট চুরি ও ডাকাতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, ভোট ডাকাতরা সিসি ক্যামেরার কানেকশন কেটে দিয়েছে। তখন সিইসি তার সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভোট বন্ধ করে দেন।
এই ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক দিনে যেদিন নানান সরকারী ও আওয়ামী লীগের বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও চট্টগ্রামে বিএনপির ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সমস্ত পত্র পত্রিকা লিখেছে যে, বিএনপিতে এই মুহুর্তে শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার মতো নেতা নাই। বেগম খালেদা জিয়া গৃহবন্দী। তারেক রহমান বিদেশে নির্বাসিত। এখন বিএনপির যেটি নেতৃত্ব সেটি হলো কালেকটিভ নেতৃত্ব বা যৌথ নেতৃত্ব। লন্ডন থেকে তারেক রহমান মাঝে মাঝে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির যৌথ নেতৃত্বকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ দেন। কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ছাড়াই দলের ডাকে লক্ষ লক্ষ জনগণ সভায় হাজির হন। একই চিত্র দেখা গেছে ময়মনসিংহের জনসভায়। এখানে সরকার এবং আওয়ামী লীগ যা করেছিল, সেটি সরকারের দুর্বলতা অথবা একদলীয় ভাবাদর্শের পরিচয় দেয়। ময়মনসিংহে প্রথমত জনসভার স্থানের অনুমতি নিয়ে পুলিশ টালবাহানা করে। তারপর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে অনুমতি দেয়, তাও ভিন্ন একটি স্থানে। শুধু তাই নয়, বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সচেতন জনগণ পূর্বাহ্নেই টের পেয়ে যান যে, জনগণ যাতে জনসভায় যোগ দিতে না পারে সেজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে পারে।
বাস্তবে হয়েছেও ঠিক তাই। ময়মনসিংহের সাথে গাজীপুরসহ আশে পাশের ৬টি জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বাস সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি প্রতিটি প্রাইভেট কার চেক করা হয় এটি দেখতে যে, প্রাইভেট যানবাহনে কর্মী এবং জনগণ বিএনপির জনসভায় যোগ দিতে ময়মনসিংহ যাচ্ছে কিনা। কর্মী এবং সচেতন জনগণ আগেই সরকারী মতলব টের পেয়ে আগের রাত্রে সভার মাঠে এসে সেখানেই ঘুমিয়ে থাকেন। সভার দিন ৪০-৫০ মাইল হেঁটে জনগণ এবং নেতা-কর্মী জনসভা স্থলে উপস্থিত হন। দেখা যায় যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের এত ব্যাপক বাধাবিপত্তি এবং হামলা সত্ত্বেও জনসমাবেশ মহাসমাবেশে পরিণত হয়েছে। সেখানে কিন্তু মির্জা ফখরুলের মতো নেতাও ৭ দিন আগে থেকে গিয়ে ময়মনসিংহে বসে মিটিং অর্গানাইজ করেননি। এই সমগ্র সভার আয়োজন তদারকি করেছেন তাদের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স। তারপরেও স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ময়মনসিংহে।
দুই.
শত বাধা বিপত্তি এবং সরকারী ও দলীয় বিঘ্ন সৃষ্টির পরেও কেন বিএনপির জনসভাগুলোতে লাখে লাখে লোক যোগ দিচ্ছে? এই বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একবারও ভেবেছেন বলে মনে হয় না। আমি আগেই বলেছি যে, বিএনপিতে কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব এই মুহুর্তে নেই। তারপরেও লোকে কার বা কিসের টানে অথবা কোন কারণে দলে দলে সভায় হাজির হচ্ছে? কারণটি অত্যন্ত সহজ ও সরল। গণতন্ত্র সংকুচিত করা এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার কথা না হয় বাদই দিলাম। যেখানে বলা হয়েছে যে, লোড শেডিংকে যাদুঘরে পাঠানো হয়েছে, সেখানে সেই লোড শেডিং যাদুঘর থেকে ভয়াল অন্ধকার রূপে ফিরে এলো কেন? ঢাকা মহানগরীতেই দিনে-রাতে তিনবার তিন ঘন্টা কারেন্ট যায়। মফস্বলে চার থেকে ছয় ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেশের ১৭ কোটি মানুষকে অ্যাফেক্ট করেছে। দেশে হেন কোনো পণ্য নাই যার দাম বিগত দেড় থেকে দুই মাসে তিন থেকে চার গুণ বাড়েনি। দ্রব্যমূল্য এমন বলগাহীন গতিতে ছুটছে যে, প্রতি সপ্তাহে শুধু নয়, তিনদিন পর পর জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে। এই বৃদ্ধি যেন হাই জাম্প ও লং জাম্পের গতিতে ছুটছে। এমনও দেখা গেছে যে, আজকে যে জিনিসটির দাম ১০ টাকা, দুইদিন পর সেই জিনিসটিরই দাম ১৬ টাকা হয়ে গেছে।
আমার আপনার অনেকেরই জানা শোনা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন। ডিমের ডজন পশ্চিম বঙ্গে ৫৫ টাকা হলে বাংলাদেশে সেটি ১৫০ টাকা হয় কিভাবে? এই ধরণের রকেটের গতিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি বিগত ৭০ বছরে দেখা যায়নি। এটি এখন কঠোর বাস্তব যে, যে ব্যক্তি মাসে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করেন তিনিও বাড়ি ভাড়া দিয়ে, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে, গোটা পরিবারের চিকিৎসা ব্যায় নির্বাহ করে এ টাকা দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারেন না। তাকেও মাস শেষে ৮/১০ হাজার টাকা ধার করতে হয়। যারা অবৈধ পথে শত শত তথা হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন এবং বিদেশে পাচার করেছেন, তারা ছাড়া এই ১৭ কোটি মানুষের প্রাণ দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে ওষ্ঠাগত। এরা এখন বাঁচার জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন। মানুষের এই কঠিন দুর্দশা সরকারের মন্ত্রী-শান্ত্রী বা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা কর্মীরা মালুমই পাচ্ছেন না।
তিন.
সেজন্যই বলছিলাম যে, জনগণ যে এখন বিরোধেী দলের দিকে ছুটছে, তার কারণ অত্যন্ত সহজ এবং সরল। এখন জনগণকে ৫০ বছর আগের কাহিনী অথবা বিভিন্ন ধরণের ‘চেতনা’র কথা বলে আর আকৃষ্ট করা যাবে না। কবি নজরুল অনেক আগেই বলে গেছেন,‘ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ/ চায় দুটো ভাত নুন’। জনগণের মধ্যে শুরু হয়েছে হাহকার। এই হাহাকার দূর করতে না পারলে জনগণ তাদের দিক পরিবর্তন করবেই।
এই পটভূমিতে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধীদল যখন বলে যে, এই সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচন হতে দেবে না, এই সরকারের পতন চায়, তারা তখন জনগণের সামনে কোনো ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে না পারলে জনগণ দিক পরিবর্তন করবেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবীবুল আউয়াল গাইবান্ধার উপ নির্বাচন বন্ধ করে অবশ্যই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এই সাহসিকতাকে প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানাতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি নির্বাচনী এলাকায় যেটি করা সম্ভব হয়েছে, সেটি কি ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় করা সম্ভব? আমি সঠিক হিসাব জানি না। কিন্তু ৩০০টি এলাকাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হলে লক্ষাধিক সিসি ক্যামেরার প্রয়োজন হবে। আর এই লক্ষ লক্ষ সিসি ক্যামেরা দিয়ে লক্ষাধিক নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করার মতো বিপুল জনবল নির্বাচন কমিশন কোথায় পাবে? কয়েকদিন আগেই দেখা গেলো যে, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপাররা ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে টাগ অব ওয়ার করছেন। তারা ইলেকশন কমিশনকে অসহযোগিতা করছেন। তারই নমুনা পাওয়া গেলো গাইবান্ধায়।
এখন যদি আগামী নির্বাচনে ৩০০টি গাইবান্ধা সৃষ্টি হয়, তাহলে তাকে সামাল দেবে কে? সেই ক্ষেত্রে যখন বিরোধীদল বলে যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন হবে না, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে, তখন সেই দাবি বিদ্যমান অবস্থায় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সরকার ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে যে, তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। ২০১৪ এবং২০১৮ সালে যা করা সম্ভব হয়েছে, সেটি ২০২৩ এর শেষে অথবা ২০২৪ এর প্রথমে করা সম্ভব হবে না। বিএনপির দুইটি জনসভাতে যা দেখা গেছে, সেই একই চিত্র ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত পরবর্তী ৮ টি জনসভায় দেখা গেলে অবাক হবো না। কারণ ঐ যে কথায় আছে, Morning shows the day, অর্থাৎ সকাল দেখলেই বোঝা যায় যে, সারাটি দিন কেমন যাবে।
ডিসেম্বরের পর বিএনপির সাথে যুক্ত হবে গণতন্ত্র মঞ্চ এবং কয়েকটি ইসলামি দলসহ আরও ২৩ থেকে ২৫ টি দল। এর মধ্যে সরকার যদি জনগণের কঠিন জীবন যাত্রাকে সহজ করতে না পারে তাহলে যে জনগণ দলে দলে জনসভায় যোগ দিচ্ছেন তারা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবেন। এগুলো কোনো উইশফুল থিংকিং নয়। এগুলো হলো বিদ্যমান পরিস্থিতির হার্ড রিয়ালিটি। তবে আমরা সাধারণ মানুষ আসা করবো, সরকার জনগণের নাড়ির স্পন্দন যেন শুনতে পান। এটিকে বলা হয়, জনগণের পাল্স সঠিক ভাবে স্টাডি করা। সেটি করতে পারলেই ভয়ংকর সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।