পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খ্রিস্টপূর্ব যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃত্ব ছিল গ্রিকদের হাতে। ৫৭০ সালে আরবে জ্ঞানের ঝান্ডা নিয়ে আগমন করেন মুহাম্মাদ (সা.)। ৬১০ সালে তিনি নবুয়াতপ্রাপ্ত হন। দিশেহারা আরববাসী নবীর (সা.) আগমনে ধন্য হয়। তাঁর প্রদত্ত জ্ঞান পেয়ে পথহারা আরবগণ পথের দিশা লাভ করে। ওহীভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ এ জ্ঞান তাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়। ঔদ্ধত্য ও উন্মত্ত এক বেশামাল জাতি বিশে^র সেরা ভদ্র জাতিতে পরিণত হয়। সময়ের ব্যবধানে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়। আরবের আকাশ প্রাচীর ভেদ করে সে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা ও ইউরোপে। ইউরোপ তখন অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পনের শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপ এ অজ্ঞতার অন্ধকারেই নিপতিত থাকে।
সপ্তম শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিমদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়টিকে ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগ বলে অভিহিত করেন। এ সময় মুসলিমগণ আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক বিভাগই সৃষ্টি করে। মুসলিমগণ ইউরোপের অলিগলি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। অধঃপতিত খ্রিস্টানদেরকে মুসলিমগণ একটি প্রগতিশীল জাতিতে উন্নীত করেন। এ উন্নতি ও প্রগতির পিছনে মুসলিমদের একমাত্র উপাদান ছিল ধর্ম। এ ধর্মভিত্তিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাছে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের প্রথম হাতে খড়ি হয়। মুসলিমদের জ্ঞানের পরশে ধীরে ধীরে ইউরোপীয়রা সমৃদ্ধ হতে থাকে। ইউরোপীয়রা বাধ্য হয়েই আরব মুসলিমদের দরজায় জোর কদমে কড়া নাড়াতে থাকে। আরবদের কাছ থেকে তারা সাধ্যমত জ্ঞান অর্জন করে নেয়। মুসলিমদের নিকট থেকে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে তারা নতুন জ্ঞান সাধনায় ক্রমশ উন্নতি করতে থাকে। ‘জ্ঞান জ্ঞানীর হারানো ধন’, বাক্যের ভিত্তিতে ইউরোপীয়রা জ্ঞানভাণ্ডারের অধিপতি বনে যায়। মুসলিমদের লালিত ধর্মের নাম হলো ইসলাম। এটি প্রচলিত কোনো রীতি-রেওয়াজভিত্তিক অভ্যাসের নাম নয়। এটি হলো সকল কালের, সকল যুগের ও সকল মানুষের জন্য প্রণীত এক সাশ্বত জীবনদর্শন। এর বিধি-বিধান কোনো মানুষের চিন্তধারায় রচিত নয়। এর প্রতিটি বিধানই স্রষ্টা কর্তৃক প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নির্দেশসূচক। সৃষ্টির উপর এ বিধানের প্রভাবও সীমাহীন। এ বিধানের মৌলিক ভাষা আরবিতে রচিত। সংগত কারণে এ ভাষার সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল অনন্য, অসামান্য ও বিস্তৃত। তাই আরব গবেষকদের ব্যবহৃত শব্দকোষ ইউরোপীয় সমাজে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। আরবদের ব্যবহৃত ভাষা, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা দ্রুতই ইউরোপের মাটিতে গ্রথিত হয়ে যায়। আরবিতে লেখা সাহিত্য আধুনিক ইংরেজি ভাষার উপরও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদাহরণ হিসেবে ইংরেজির উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী কয়েকটি আরবি শব্দ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১. ইংরেজি ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি শব্দের নাম ‘সিরাপ’। আরবি ‘শরাব’ শব্দ হতে এর উৎপত্তি। শব্দটি ইংরেজিতে বিকৃত হয়ে ‘সিরাপ’ নাম ধারণ করেছে। ২. ইংরেজিতে ব্যবহৃত একটি প্রসিদ্ধ শব্দের নাম ‘সুগার’। এর বাংলা অর্থ চিনি। এ শব্দটি আরবি ‘সুক্কার’ শব্দ হতে উৎপত্তি। ইংরেজিতে পরিবর্তন হয়ে এটি ‘সুগার’ নাম ধারণ করেছে। ৩. ইংরেজি র্আথ শব্দের অর্থ হলো পৃথিবী। এটি আরবি ‘র্আদ’ শব্দ হতে নির্গত হয়েছে। আরবি শব্দ পরিবর্তিত হয়ে ইংরেজিতে এটি র্আথ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ৪. আরবি ‘কিনদি’ শব্দের বাংলা অর্থ মিছরী তথা জমাট বাঁধা মিষ্টান্ন। এটি পরিবর্তন হয়ে ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় ‘ক্যান্ডি’। ৫. আরবি ‘আলজাবার’ শব্দের বাংলা অর্থ বীজগণিত। এটি পরিবর্তন হয়ে ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় ‘অ্যালজেবরা’। ৬. আরবি ‘ক্বাহওয়া’ শব্দের বাংলা অর্থ কফি। এটিকে পরিবর্তন করে ইংরেজিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘কফি’। ৭. আরবি ‘ইয়াসমীন’ শব্দটির বাংলা অর্থ এক জাতীয় ফুল। এটি বিকৃত হয়ে ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় ‘জেসমিন’। ৮. আরবি ‘লেম’ থেকে ইংরেজিতে গিয়ে ব্যবহৃত হয় ‘লেমন’। এটির বাংলা অর্থ লেবু। ৯. আরবী ‘আমীরুল বাহার’ এর বাংলা অর্থ সমুদ্রপতি বা নৌ কমান্ডার। ইংরেজিতে পরিবর্তিত রূপ হলো ‘এডমিরাল’। ১০. আরবি ‘কিমি‘আ’ শব্দটির বাংলা অর্থ কালো মাটি। ইংরেজিতে গিয়ে ব্যবহৃত হয় ‘কেমিস্ট্রি’। এজাতীয় আরো অসংখ্য শব্দ পাওয়া যাবে যা মূলত আরবি; কিন্তু ইউরোপীয়রা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেগুলোকে পরিবর্তন করেছে। এটি অতীত মুসলিমদের জ্ঞান চর্চার প্রকৃত ইতিহাসের অতি সামান্যতম একটি অংশ। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বারো শতাব্দীর পর থেকে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছেড়ে দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, নেতৃত্ব আর সম্পদের প্রাচুর্যে তারা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতে থাকে। পূর্বপুরুষের সাধনালব্ধ জ্ঞান ও সম্পদের উপর নির্ভর করে তাদের জীবন গতানুতিক ধারায় চলতে থাকে। তারা ধর্ম পালন ও প্রচারের বিষয়ে অমনযোগী হয়ে পড়ে। অপরদিকে ইউরোপ যেটুকু জ্ঞানের আলো মুসলমানদের নিকট থেকে লাভ করেছিল তার ভিত্তিতে নতুন জ্ঞান সাধনায় ক্রমেই অগ্রসর হতে থাকে।
এটি ঠিক সে সময়ের কথা, যখন ইউরোপজুড়ে খ্রিস্টান পাদ্রীদের শাসন প্রথার প্রচলন ছিল। পাদ্রীরা ধর্মের নামে মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রভুত্ব কায়েম করে নিয়েছিল। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে রাজত্ব চালু করেছিল। অথচ তাদের নিকট আল্লাহর বিশুদ্ধ বাণীর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পাদ্রীরা খোদার নামে নিজেদের মন গড়া মত চালু করে নিয়েছিল। তারা মানুষের নিকট ধর্মের নামে অধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের নির্দেশ জারি করেছিল। শাসন ক্ষমতা তাদের হাতের মধ্যেই কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। জীবনের প্রত্যেক দিক ও বিভাগে তারা প্রভাব বিস্তার করেছিল। গায়ের জোরেই পাদ্রীগণ জনগনের আনুগত্য আদায় করে নিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষ হওয়ায় পাদ্রীদের সকল মনগড়া আইন ধরা পড়ে যায়। পাদ্রীদের মনগড়া মতামত খ্রিস্টান গবেষকদের নিকট ভুঁয়া বলে প্রমাণিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের রহস্য যতই উদঘাটিত হতে থাকে, পাদ্রীদের সাথে জ্ঞান সাধকদের মতবৈষম্য ততই প্রকট হয়ে উঠে। বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকটি নতুন গবেষণা ক্ষমতাসীন পাদ্রীদের ধান্ধাবাজি প্রকাশ করে দেয়। পাদ্রীগণ তখন অনন্যোপায় হয়ে ধর্মের দোহাই পাড়তে শুরু করলো। শাসনশক্তি প্রয়োগ করে তারা গবেষকদেরকে নির্দয়ভাবে শায়েস্তা করতে লাগলো। বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত কার্যকর করতে লাগলো। পাদ্রীদের নির্দেশ অমান্য করায় গ্যালিলিওসহ শত শত জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তিবর্গকে চরম দন্ড ভোগ করতে হলো। পাদ্রীদের এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিন্তাশীলদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। চিন্তক, গবেষক ও সুশীল সমাজের লোকজন পাদ্রীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলো। গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে ধর্মের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠল। পাদ্রীদের নিজস্ব মনগড়া মতামতের অসারতা যতই প্রমাণিত হলো, ততই এ বিদ্রোহ অধিকতর বেগবান হতে লাগলো। ফলে চিন্তাশীল ও সুশীল সমাজের মনে তীব্র ধর্মবিদ্বেষ সৃষ্টি হলো। তারা ধর্মের সকল বিধান বর্জনের ঘোষণা দিলো। তারা ধর্মকে মানুষের কল্যাণের বিরোধী বলে মন্তব্য খাড়া করল। তারা ঘোষণা দিলো, ধর্ম হলো ধার্মিকদের ব্যবসা। এটি প্রগতি ও উন্নতির অন্তরায়। তাই এটি পালনের যেমন কোনো প্রয়োজন নাই, তেমন বাধ্যবাধকতাও নাই।
বিদ্রোহীরা বেপরোয়াভাবে পাদ্রীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করলো। পাদ্রীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মান্ধ জনতাকে সাথে নিয়ে এ বিদ্রোহ মোকাবেলা করলো। রাজশক্তির সহায়তায় পাদ্রীগণ দৃঢ়ভাবে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো। অন্যদিকে জীবনের সকল বিভাগ থেকে পাদ্রীদের উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিদ্রোহীরা অগ্রসর হলো। দুই পক্ষের প্রবল এ প্রতিরোধ ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হলো। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের সময়সীমা দীর্ঘ হলো। ষোল ও সতর শতাব্দী দুইশত বছর ধরে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকলো। এ সংগ্রাম ইতিহাসে ‘গীর্জা বনাম রাষ্ট্রের’ যুদ্ধ নামে পরিচিতি পেলো। যুদ্ধের ভয়াবহতায় দু’পক্ষই বিব্রত ও ক্লান্ত হয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় দেশে সংস্কারবাদী নামক একটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটলো। সংস্কারবাদীগণ দু’পক্ষের মধ্যে আপোস ও সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলো। এ সংস্কারবাদীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্টিন লুথার। তিনি ছিলেন জার্মান ধর্মযাজক ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক। তার নেতৃতেই গঠিত হলো সমঝোতা আন্দোলন; যা ইতিহাসে ‘আপোস আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এ আন্দোলনের প্রস্তাব হলো যে, ‘ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকুক। মানুষের ধর্মীয় দিকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চার্চের হাতেই ন্যাস্ত থাকুক। কিন্তু সমাজের পার্থিব জীবনের সকল দিকের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত থাকবে। পার্থিব কোনো বিষয়েই চার্চের কোনো প্রাধান্য থাকবে না। অবশ্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবার শপথ পাদ্রীর নিকটই গ্রহণ করতে হবে।’
সকল দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাব উভয় পক্ষই গ্রহণ করতে রাজী হলো। পাদ্রীরা নিজেদের অবস্থা সমন্ধে সচেতন ছিল। তারা বুঝতে পারলো যে, সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সমর্থন ছাড়া শুধু ধর্মান্ধ জনতার সাহায্যে নেতৃত্ব চলে না। বিশেষত দুইশত বছর সংগ্রাম পরিচালনার পর ভিতরে ভিতরে তারা হতাশ হয়ে গিয়েছিল। তারা সম্পূর্ণভাবে জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিল। ভিতরে ভিতরে তারা পরাজয়ের মধ্যেও নিজেদের জন্য একটু ইজ্জত খুঁজে ফিরছিল। রাষ্ট্র পরিচালকদের চার্চে শপথ গ্রহণ করার প্রস্তাবটা পাদ্রীদের কিছুটা পছন্দ হলো। এতে ইজ্জত রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে বলে তারা মনে করলো। অতঃপর তারা সসম্মানে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হলো।
অপরদিকে বিদ্রোহীরা ধর্মকে উৎখাত করার ব্রত নিয়েই জয়ের পথে এগিয়ে চলছিল। তবুও তারা এ চিন্তা করেই আপোসে রাজি হলো যে, পার্থিব জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ধর্মের কোনো প্রাধান্য আর থাকছে না। তার মানে হলো, ধর্ম একটি বিষদাঁতহীন সাপে পরিণত হলো। সুতরাং ধর্মকে আর ভয় করার কোনো কারণ অবশিষ্ট রইলো না। তাই তারা চার্চকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত হলো। রাষ্ট্র পরিচালকদের চার্চের নিকট শপথ গ্রহণ করার বিষয়েও ধর্মদ্রোহীদের আপত্তি থাকলো না। এ আপোসে পাদ্রীগণ মূলত মূল্যহীন তৃতীয় শ্রেণীতে পরিণত হলো। এভাবে সমাজ জীবন থেকে ধর্ম স্থায়ীভাবে নির্বাসিত হলো। ইতিহাসে এটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’ নামে পরিচিতি পেলো। ইংরেজিতে এটাকে ‘সেকিউলারিজম’ বলা হয়ে থাকে। ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক এটিকে সর্বপ্রথম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মতবাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।
উল্লেখিত পুরো ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, তৎকালীন খ্রিস্টান পাদ্রীদের নিকট আল্লাহ প্রদত্ত সত্য কোনো বিধান ছিল না। তারা ধর্মের নামে যা প্রচার করতো তা আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ছিল না। তারা পূর্বের গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানের উপর মনগড়া ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলে তাদের মতবাদের সূত্রসমূহ ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হলো। কিন্তু স্বার্থপর পাদ্রীগণ বিকশিত নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধিতা শুরু করে দিলো। তারা যুক্তিতে হেরে গিয়ে পেশিশক্তির আশ্রয় গ্রহণ করলো।
প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের এ সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না। এ সংগ্রাম ছিল নীতিহীন ও ধান্ধাবাজ পাদ্রীদের বিরুদ্ধে। তবে এটাও সত্য যে, নতুন জ্ঞান সাধকদের ধর্ম সমন্ধে সঠিক কোনো ধারণাই ছিল না। তারা ভ্রান্ত ধর্মের বিরুদ্ধেই জিহাদে লিপ্ত হয়েছিল। সুতরাং একথা দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যায় যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সত্য ধর্ম ইসলামের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। বর্তমানে সুশীল সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি ঐ উদাহরণ টেনে ধর্ম বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছেন। অজ্ঞতার কারণে ইসলামকে তারা উন্নতি ও অগ্রগতির অন্তরায় মনে করে নিয়েছেন। বিগত দুইশত বছর ধরে এ মতবাদটি বিশে^ একটি স্বীকৃত মতবাদ হিসেবে স্থান পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আধুনিক মুসলিম বিশে^র অনেক দেশেই এটি সাংবিধানিক রুপ পেয়েছে। মুসলিম বিশে^র তুরস্কে সর্বপ্রথম কামাল আতাতুর্কের (১৯২৩-১৯৩৮) মাধ্যমে এটি সাংবিধানিক রূপ পায়। ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষিত মুসলিম দেশগুলোতে তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মকে মুক্ত রাখা হয়েছে।
ব্যাপকার্থে এটি ধর্মহীনতা না হলেও সুশীল নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো দেশের সকল স্থান থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। এদেশের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ মন্দির বা গির্জায় যেতে কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ করেন না। গীর্জায় ও মন্দিরে গেলে তখন তারা ঐ ধর্মের পক্ষেই কথা বলেন। ধুতি, পৈতা, ক্রুশ, উত্তরীয় ও গৌর বসনে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। শাখা-সিঁদুরের ক্ষেত্রেও এ সমস্ত লোকজন সেকুলার মনোভব পোষণ করেন না। কিন্তু যত সমস্যা সৃষ্টি হয় মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোর ক্ষেত্রে। এসব জায়গায় সুশীল সমাজের লোকজন খাঁটি সেকুলার মনোভাব পোষণ করেন। মসজিদ-মাদ্রাসা তাদের গাত্রদাহের কারণ বলে তাদের আচরণে প্রকাশ করেন। দাঁড়ি, টুপি ও বোরকার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা বোধ করেন। তারা এক্ষেত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ সূত্রের আবিষ্কারক এসব দাঁড়ি-টুপিধারী ব্যক্তি। জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, উমার খৈয়ম ও ইবনে রুশদের নাম জানে না, পৃথিবীতে এমন কোনো বিজ্ঞানী নেই। এসকল ব্যক্তি ছিলেন দাঁড়ি-টুপিওয়ালা। অথচ, তারা সবাই ছিলেন এক একজন আধুনিক যুগের আইনস্টাইন। তারা ছিলেন মুসলিম সোনালি যুগের এক একজন গবেষক ও আবিষ্কারক। তারা সবাই ছিলেন ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। তাদের কেউই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। তাদের জ্ঞান গবেষণার সাথে ধর্মের কোনো বিরোধতো ছিলই না, বরং এ জ্ঞান-গবেষণার মৌলিক উৎস ছিল আল কুরআন। এ আল কুরআন মানুষদেরকে ভাবতে, চিন্তা করতে ও গভীর অনুসন্ধান করতে নির্দেশ প্রদান করেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অনেকেই সম্ভবত এটা জানেন না। অথবা জেনে-বুঝেই তারা ইসলাম ধর্মের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ করে চলেছেন। একজন মুসলিম হিসেবে একদিকে যেমন এটা দুঃখজনক তেমনি নিন্দাজনকও বটে। ধর্ম নিয়ে এ জাতীয় দ্বিমুখী নীতি প্রদর্শন মোটেই কাম্য নয়।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।