পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতিটি মানুষের যেমন দৈহিক স্বাস্থ্য আছে, তেমনি মনেরও স্বাস্থ্য আছে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর ভালো না থাকলে আমরা মনের দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আমাদের আচরণের মাধ্যমে। বাস্তব জীবনে ইতিবাচক আবেগীয় অবস্থা এবং মানসিক তৃপ্তি লাভের মধ্য দিয়ে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক। এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।
শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ অবস্থা ও পরিবেশের সাথে সুসংগতি বিধান করাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের সকল আচরণই উদ্দেশ্যমুখী। এ উদ্দেশ্যমুখী আচরণের মূলে রয়েছে কতগুলো চাহিদা। মানুষ যদি বাস্তব জীবনের সকল সমস্যা ও সংকট মেনে নিয়ে তার চাহিদাগুলো স্বল্পতম সংঘর্ষ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করতে পারে। তবেই ইতিবাচক আবেগীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়, মানসিক তৃপ্তি লাভ হয় এবং সংগতি বিধান সম্ভব হয়। এ সার্থক সংগতি বিধানের মধে দিয়েই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা হয়। আর যদি কোনো কারণে মানুষ তার চাহিদাগুলো মেটাতে বা পরিতৃপ্ত করতে না পারে তবে নেতিবাচক আবেগীয় অবস্থা দেখা যায়। এর ফলে প্রক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই প্রক্ষোভই মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মানুষের আচরণের মাধ্যমে। সুতরাং দেখা যায় যে, মানুষের চাহিদা অর্জিত হলে পরিবেশের সাথে সংগতি বিধান সম্ভব হয় এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ডঐঙ)- এর মতানুসারে, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়েছে তখনই বলা যায়, যখন ব্যক্তি মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক দিক থেকে সুস্থ নিরোগ ও সুখী হয় এবং জীবনের সর্বস্তরেই তার কুশলতা বর্তমান থাকে।
ডঐঙ মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যাখ্যা করে মানসিক সুস্বাস্থ্য হিসেবে মত দিয়েছে যে, মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ সে, যে তার নিজের ক্ষমতা বুঝতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপসমূহের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে এবং সমাজে সর্বস্তরে অবদান রাখতে পারে। মানুষ যে কোনো সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। শরীরের সাথে মনের একটি আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপকের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আমাদের মন কখনো কখনো উৎফুল্ল এবং কখনো দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই সবসময় মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
মানসিক স্বাস্থ্যের বৈশিষ্টগুলো হলো: ১। শারীরিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ: শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। তাই মনকে ভালো রাখতে হলে অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। অন্যদিকে চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তি প্রয়োগ ও বিচার করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। ২। আত্মবিশ্বাস: ব্যক্তির দৃঢ় চিত্ত ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ৩। পরিস্থিতি মানিয়ে চলা: মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তিরা জীবনে কোথাও পিছপা হয় না। তারা খুব দৃঢ়চিত্তের হয়। মানসিক শক্তির কারণে তারা যে কোনো পরিবেশ মোকাবেলা করতে পারে। ৪। পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি: মানসিক স্বাস্থ্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হলো আত্মতৃপ্তি। ব্যক্তির পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তিই হলো মানসিক স্বাস্থ্যের একটি লক্ষণ। ৫। নিজের চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতা: মানসিক সুস্বাস্থেরর অধিকারী ব্যক্তি তার চাহিদার মাত্রা সম্পর্কে সব সময় সচেতন থাকে। অবাস্তব চাহিদা সৃষ্টি করে সে অসুখী হতে চায় না। ৬। আত্মমূল্যায়ন ক্ষমতার অধিকারী: মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারীরা সব সময় নিজের মূল্যায়ন করতে পারে অর্থাৎ তারা নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতই মানসিক ব্যাধি। এটি ব্যক্তির আচরণের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতিগতভাবে আত্মপরাজয়মূলক এবং অসংলগ্ন। এই আচরণ ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এই রোগে কয়েক ধরনের বিপর্যস্ত অবস্থার উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ পায়। এছাড়া এই উপসর্গগুলি মানসিক বা শারীরিক লক্ষণ অথবা উভয় প্রকারেই প্রকাশ পেতে পারে। যদিও বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভুগছে, তথাপি এই রোগটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। বাংলাদেশে এই রোগের ব্যাপকতা সম্ভবত অন্যান্য উন্নত দেশের প্রায় সমান।
মানসিক রোগকে বিভিন্ন উপায়ে ভাগ করা যায়। মনোবিকার নামক মানসিক রোগে চিন্তাশক্তি, অনুভূতি এবং আচরণের সুস্পষ্ট অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের অসুস্থতা একজন ব্যক্তিকে সমাজে কাজ করার অনুপোযোগী করে তোলে। মনোবিকারগ্রস্থ রোগীর ক্ষেত্রে অন্তর্দৃষ্টি কাজ করে না এবং বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের রোগীদের মধ্যে চিন্তাশক্তির অস্বাভাবিকতা ভ্রান্তির সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ভ্রান্ত ধারণাগুলি সাধারণত অনুভূতি অথবা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ভুল পথে প্রয়োগ করা হয়। এসব রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণত কোন উপযুক্ত বাহ্যিক উদ্দীপনার অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্ট একটি চেতনাবাহী অনুভূতি বা মতিভ্রম ঘটতে পারে। বাংলাদেশের এ জাতীয় জটিলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রায়শই পাগল অথবা উন্মাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সিজোফ্রেনিয়া এবং চিত্তবৈকল্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়ামূলক মনোবিকার। সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ মন ভেঙ্গে যাওয়া। অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানসিক কাজকর্মের বিশৃঙ্খলতা বা যোগাযোগহীনতা। ভ্রান্তি, মতিভ্রম, অসংলগ্ন কথাবার্তা, অসংলগ্ন আচরণ এবং নেতিবাচক ধারণা ইত্যাদি সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্থ রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল রোগীর মধ্যে প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যেই মনোবিকার রোগ সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়।
নিউরোসিস বা স্নায়ুবিকার আবেগজনিত জটিলতা যা প্রাথমিকভাবে দুশ্চিন্তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। স্নায়ুবিকার মনোবিকারের তুলনায় কম মারাত্মক। স্নায়ুবিকারগ্রস্থ ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক এবং কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবাস্তব এবং অসংগত ভীতি বা দুশ্চিন্তা এ ধরনের জটিলতার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। দুশ্চিন্তাজনিত জটিলতার মধ্যে রয়েছে: আতঙ্ক, ভীতি, সাধারণ দুশ্চিন্তাগত জটিলতা, বাতিকগ্রস্ত জটিলতা, আঘাত-উত্তর চাপজনিত জটিলতা ইত্যাদি।
ব্যক্তিত্বজনিত জটিলতা হলো দীর্ঘস্থায়ী অনমনীয়, অসংলগ্ন অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা এবং আচরণ, যা সামাজিক অথবা পেশাগত কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যক্তিত্বজনিত জটিলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের মধ্যে দেখা যায় এবং এই জটিলতা যুবক ও অল্পবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বস্তুসংশ্লিষ্ট জটিলতা পুনঃপুন অধিক মদ্যপান ও মাদকের ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট অসংলগ্ন আচরণ। এ ধরনের আচরণ ব্যক্তিবিশেষ এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে আইনগত, সামাজিক অথবা পেশাগত সমস্যা সৃষ্টি হয়। মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই সমস্যা নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ এবং ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ বিকাশের ফলে সৃষ্ট অবনমিত বুদ্ধিমত্তা। এতে শৈশবকাল থেকেই বুদ্ধিমত্তার অভাব, বেড়ে ওঠার সময়কালে স্বল্প ও মন্থর মানসিক বিকাশ, খর্বিত শিক্ষণক্ষমতা এবং দুর্বল আচরণগত ও সামাজিক অভিযোজ্যতা দেখা দিতে থাকে। এটি একটি স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা, কিন্তু কোনো রোগ নয়। বুদ্ধিগত ঘাটতির মাত্রানুসারে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের চারটি দলে ভাগ করা যায়: মৃদু, মাঝারি, মারাত্মক ও সার্বিক। ১৯৬৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর মানসিক প্রতিবন্ধিগ্রস্ত শিশুদের পিতা-মাতারা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ১৯৮০ সালের ২২ জুন ঢাকায় মানসিক প্রতিবন্ধীদের ওপর প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অনুন্নত। এদেশে সরকারিভাবে মানসিক অসুস্থ লোকের যত্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৯৫৭ সালে পাবনায় ষাট শয্যাবিশিষ্ট একটি মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয়। শয্যা সংখ্যা পরবর্তীতে বৃদ্ধি করে চারশতে উন্নীত করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ঢাকায় উপজেলা চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক চিকিৎসার উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিছু বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট মানসিক রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মনোরোগ বিশারদ রয়েছেন স্বল্পসংখ্যক। ঢাকা এবং অন্যান্য কিছু শহরে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুবিধাদি পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠী এ ধরনের সেবা ও সুবিধাদি খুব অল্প মাত্রায় ভোগ করে থাকে। এখনও মানসিক রোগের ক্ষেত্রে পূর্বসংস্কার, কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা দেশে বিভিন্ন এলাকার লোকেদের মধ্যে দেখা যায়। মানসিক অসুস্থতা অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা অথবা ভৌতিক শক্তির দ্বারা ঘটে এবং এদের অধিকাংশই অনিরাময় যোগ্যÑ এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে মানসিকভাবে অসুস্থ অনেক রোগীই ধর্মীয় ও সনাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করে। এছাড়া ফকির, কবিরাজ এবং জাদুকরের কাছেও চিকিৎসার জন্য গিয়ে থাকে। এদের অধিকাংশই রোগীদের অসংলগ্ন চিকিৎসা প্রদান করে এবং শোষণ করে। বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে জ্ঞান এবং সচেতনতা এখন পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং মানসিক রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য কোন উন্নত কেন্দ্র নেই। মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং দেশে আধুনিক ব্যবস্থাপনা সুবিধাদির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।