পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি অমর গান লিখেছেন। গানটি সংগীত ভূবনে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজও মানুষ অবসর সময়ে এই গানটি শোনেন। গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন হলো, ‘শাওন আসিল ফিরে / সে ফিরে এলো না/ বরষা ফুরায়ে গেল/ আশা তবু গেল না’। জাতীয় কবির এই অসামান্য জনপ্রিয় গানটির কথা মনে পড়লো লোড শেডিংয়ের কথা ভেবে। সরকারের রথি-মহারথিরা বলেছিলেন, এমনকি স্বয়ং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, সেপ্টেম্বর মাসের পর আর লোড শেডিং থাকবে না। অক্টোবর মাসে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সেপ্টেম্বর চলে গেল। অক্টোবর এলো। এই লেখা যখন লিখছি তখন খবর পেলাম, এই মাহানগরী ঢাকার একটি এলাকায় দুই ঘণ্টা ধরে কারেন্ট নাই। আরেকটি এলাকা থেকে খবর পেলাম, সেখানে সকাল বেলা ১ ঘণ্টা লোড শেডিং হয়েছিল। হয়তো বিকাল বেলা আরেকবার হবে। আমার এলাকা কলাবাগান। এখানে প্রতিদিন দুই বার কারেন্ট যায়। একবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা। আরেকবার বিকাল ৪টা থেকে ৫টা। লোড শেডিং বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, কমারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে সরকারের বড় কর্তা, এমনকি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও একই কথা বলেন। তিনি কীভাবে এমন অবাস্তব কথা বলেন? এই মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণ মন্ত্রী নাই। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি বিভাগের মন্ত্রী। এই মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় একজন উপদেষ্টা আছেন। নাম তৌফিক এলাহী চৌধুরী। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্ট। এই ধরনের হেভি ওয়েট এই মন্ত্রণালয়ে থাকতে এমন কথা সরকারের অন্যান্য কর্ণধার কেমন করে বলেন, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়? অক্টোবরের শেষে অথবা নভেম্বরের প্রথমে লোড শেডিংয়ের ফ্রিকুয়েন্সি এবং ডিউরেশন হয়তো কিছুটা কমতে পারে। সেটা নেহায়েত প্রাকৃতিক কারণে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে গরম কমে যাবে। নভেম্বরে কোনো গরম থাকবে না। বরং একটু হিম হিম ভাব থাকবে, যেটা উপভোগ করতে ভালই লাগবে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মোটামুটি শীতের সময়। এই সময় এয়ার কন্ডিশনার চলবে না, পাখা চলবে না, দোকানপাটে এমনকি বাসা বাড়িতেও জেনারেটর এবং আইপিএস ও ইউপিএস খুব কমই চলবে। এসব কারণে হয়তো ঐ ক’টা মাস লোড শেডিংয়ের ডিউরেশন অর্থাৎ সময়টা কমে যেতে পারে। কিন্তু মার্চ-এপ্রিলে? বিশেষ করে এপ্রিলে? এপ্রিলে তো পুরো গরম পড়ে যায়। তখন তো আবার এসি থেকে শুরু করে সবগুলো যন্ত্র চলবে। তখন সরকার লোড শেডিং আগের মতো অবস্থায় রাখবে কীভাবে? লোড শেডিংয়ের কারণ নিয়ে আমি বিশেষজ্ঞ না হয়েও এই সময় এ বিষয়ে বেশকিছু পড়াশোনা করেছি। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে, ডেসা বা ডিপিডিএসে উচ্চ পদে চাকরি করেছেন বা করছেন, তেমন কিছু ব্যক্তির সাথেও কথা বলেছি। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, লোড শেডিং আগামী ২/৩ মাস কেন, ৬ মাস বছরেও দূর হবে না। কারণ, যে কারণে লোড শেডিং শুরু হয়েছে সেই কারণগুলোর একটাও তো দূরীভূত হয়নি।
লোড শেডিং তথা জ্বালানির বিষয়টি টেকনিক্যাল হলেও সেই জুলাই মাস থেকে যখন সেটি শুরু হয়েছে তখন থেকে এ পর্যন্ত আড়াই মাস ধরে এ বিষয়ে দেশের পত্র পত্রিকা তথা সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে। সুখের বিষয় হলো এই যে, এসব বিষয়ে এবার বিশেষজ্ঞরাও আলোচনা বা লেখালেখিতে যোগ দিয়েছেন। যেহেতু লোড শেডিংয়ের বিষয়টি দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকেই প্রবলভাবে স্পর্শ করে তাই এরা, যারা মোটামুটি লেখাপড়া জানেন, তারা এসব আলোচনা শুনেছেন বা লেখালেখি পড়েছেন।
॥দুই॥
আসলে লোড শেডিং কেন হলো? সোজা উত্তর হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন সেই পরিমাণ জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার ফলে আগের চেয়ে কম পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব তাই উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে সরবরাহ এবং উৎপাদনের মধ্যে একটি ফারাক থেকে যাচ্ছে। সরবরাহ যতটুকু কম ততটুকুই লোড শেডিং করা হচ্ছে। যে কোনো সাধারণ মানুষও বুঝবে যে, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতখানি ইনপুট প্রয়োজন হয় ততখানি ইনপুট দেওয়া গেলে আউটপুটও বাড়বে ততখানি, যতখানি আমাদের প্রয়োজন। সরকারের কর্তারা আগামী দুই-চার মাসে কি প্রয়োজন মাফিক ইনপুট দিতে পারবেন?
গত শুক্রবারের একটি পত্রিকার প্রধান সংবাদ থেকে জানা গেল যে, এর আগের দুদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেছে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। আমাদের প্রয়োজন, এই মুহূর্তে অন্তত ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এই আড়াই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্য যে ইনপুট বা রসদ প্রয়োজন সেটি দিতে দিতে পারলেই তো বিদ্যুৎ সংকট থাকে না।
এই বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভেতরে যাবো। তার আগে আকেরটি হতাশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া গেল। এই খবরটি শুধু হতাশাই সৃষ্টি করে না, রীতিমত ক্রোধেরও সঞ্চার করে। খবরটিতে বলা হয়েছে যে, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে বিদ্যুতের দাম নাকি ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। এই ধরনের খবর সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য এবং তোঘলকি ব্যাপার মনে হয়। এমনিতেই তো প্রতিদিন ঢাকা মহানগরীতে কম করে হলেও ২ ঘণ্টা আর সুদূর মফস্বলে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা কারেন্ট থাকে না। সেখানে এক লাফে ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ালে মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে। নাভিশ্বাস ইতোমধ্যেই উঠে গেছে। এখন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি হবে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো। বিদ্যুতের দাম আর কতবার বাড়ানো হবে? এই সরকারের আমলেই বিগত ১৪ বছরে অন্তত ২০ বারের বেশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন আর রয়ে সয়ে বাড়ানো নয়। একবারে লং জাম্প বা হাই জাম্পের মত ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি। আমরা অর্থাৎ জনগণ তো সব কলুর বলদ। যত ভারি জোঁয়ালই চাপানো হোক কেন, বলদকে তো সেই জোঁয়াল টানতেই হবে। আর এখানে আরেকটি ব্যাপার ঘটছে। সেটি হলো, আস্তে মূল্য বৃদ্ধি মানুষের গা সওয়া হয়ে যায়। যেমন হয়েছে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে সব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। আমাদের শুধু এটুকুই প্রশ্ন যে, বিরোধী দলীয় রাজনীতিকে দমন করার জন্য সরকার যে কঠোরতা অবলম্বন করে এবং যে এনার্জি খরচ করে, সেই এনার্জি এবং কঠোরতা আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণে দেখা যায় না কেন?
॥তিন॥
লোড শেডিং তথা বিদ্যুৎ সংকটের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাব। আরো অন্যান্য সূত্র থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সেগুলো হলো, গ্যাস ছাড়াও, কয়লা, তেল, পারমাণবিক শক্তি, পানি, বায়ু, সৌর ইত্যাদি। এগুলোর সরবরাহ বৃদ্ধি না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। এখানেও কিছু কথা আছে। এক এক সূত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে একেক রকম খরচ পড়ে। কিন্তু সেই খরচ করার সাধ্য কি আপনার আছে? আজ আমি টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে মোটেই যাবো না। প্রয়োজন হলে আরেক দিন পিওরলি টেকনিক্যাল বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করবো। আজকে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তার ৬৯ শতাংশ আসে গ্যাস থেকে। সেই গ্যাস থেকেই আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা এতদিন ধরে মেটানো হচ্ছিল। কিন্তু সেই গ্যাসের বিশেষ করে লিকুইফায়েড প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। যার দাম ছিল ৮০ ডলার থেকে ৮৫ ডলারের মধ্যে, সেটি হঠাৎ করে ১৪০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। কিন্তু আজব ব্যাপার হলো এই যে, যখন সেই দাম কমতে থাকে এবং যখন সেই দাম ১০০ ডলারের নিচে পড়ে যায় তখনই মধ্যরাতে আমাদের দেশে জ¦ালানির দাম বাড়ানো হয়।
এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে অনেক কথা আছে। এখন তো গ্যাসের দাম অনেক কম। ৮৬ থেকে ৯০ ডলারের মধ্যে। এখন আগের মতো করে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন তো বাড়ানো যায়। তাহলে সেটা করা হচ্ছে না কেন? এসব ‘কেনর’ জবাব সরকার দিচ্ছে না। তবে আমরা ধারণা করি যে, সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দারুণ টান পড়ে গেছে। এই বছরেই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। তারপর বেশ কয়েক মাস ৪৪ থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই রিজার্ভের পরিমাণ উঠা নামা করে। এখন অফিসিয়ালি আমাদের রিজার্ভ সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমাদের রিজার্ভ ১১ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। অবশ্য এই সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের হিসাবের সাথেও আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) একমত নন। তার মতে, সরকার রফতানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করে সেখান থেকে ৬ বিলিয়নেরও বেশি ডলার ঋণ দিয়েছে। সেটাও রিজার্ভে ধরতে হবে। তাহলে আমাদের রিজার্ভ হবে আনুমানিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এটি দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ মাসের আমদানি খরচ মেটানো যায়।
এই ৩১ বিলিয়ন ডলার থেকে নতুন করে আবার গ্যাস আমদানির জন্য সরকার খরচ করতে চায় না। খরচ করতে না চাইলে গ্যাস আসবে কোত্থেকে? এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমরা আজকের আলোচনায় ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি। সেটি হলো, আমাদের নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনের প্রচেষ্টা বিগত ১৫/১৬ বছরে তেমন একটা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সেই কাজটি জোরে সোরে করা হতো তাহলে গ্যাসের জন্য আজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো না। এগুলো নিয়ে আমি আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমরা সময় মতো কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারিনি, সমুদ্রবক্ষ থেকে অথবা স্থলভূমি থেকে প্রয়োজন মতো গ্যাসকূপ খননে নজর দেইনি, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উপেক্ষা করেছি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করিনি। দুর্বোধ্য কারণে কর্তৃপক্ষের সমস্ত মনোযোগ ছিল এলএনজি আমদানি করা এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, অর্থাৎ রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ওপর। শুধু পলিটিশিয়ান নন, বিশেষজ্ঞরাও বলছেন যে, এই এলএনজি আমদানি এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টালে বিশাল দুর্নীতি করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সেজন্যই আসল এবং মৌলিক কাজে মনোযোগ না দিয়ে এলএনজি এবং রেন্টালের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এখন এই মুহূর্তেও যদি নিজস্ব গ্যাস, কয়লা, প্রাকৃতিক জ্বালানি ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয় তাহলেও তার ফসল ঘরে তুলতে কম করে হলেও ৩ থেকে ৫ বছর লাগবে। তাই শুরুতেই আমি বলেছি যে, এতদ্রুত লোড শেডিং দূর করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এখন যে পরিমাণ টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছি, তার দেড়গুণ বিল পরিশোধ করার জন্য আমরা অসহায় ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।