পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়েছে ইডেন কলেজ। যদিও ইডেন কলেজে ছাত্রী সংগঠনের এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। অথচ দেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম সবার আগে সামনে আসে, রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ তাদের অন্যতম। এই কলেজের ওয়েবসাইটে সার্বক্ষণিকভাবে যে স্ক্রলটি চলে, সেখানে লেখা আছে: ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই, শঙ্কামুক্ত জীবন চাই।’ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক দলাদলি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা অনৈতিক অভিযোগের কারণে এই কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে আবাসিক হলে থেকে যারা পড়াশোনা করে, তারা কতটা শঙ্কামুক্ত, তা নিয়ে আগেও বহু প্রশ্ন উঠেছে আর এখনতো তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে হলে থাকা অনেক ছাত্রীকে দিয়ে নানারকম অনৈতিক কাজ করানো; এমনকি দলীয় পদ-পদবি পাওয়াসহ নানারকম স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ হাসিলের জন্য তাদেরকে নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কোন রাজনৈতিক নেতার ‘শয্যাসঙ্গী’ হতে বাধ্য করার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছে তাদেরই কমিটির অন্যান্য সদস্য। সেই সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবারেও কলেজ ছাত্রলীগের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করেছে কলেজ প্রশাসন। তবে তদন্ত কমিটিতে কারা রয়েছেন বা কত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা পড়বে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানায়নি কর্তৃপক্ষ।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সব দোষ কি ছাত্ররাজনীতির? বা ইডেনের? তাহলে নারীশিক্ষায় দেশসেরা রাজধানীর নামকরা ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু ছাত্রীর দুষ্কর্মের পুরো দায় ছাত্ররাজনীতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার ধুম চলছে কেন? সেইসঙ্গে ইডেনকে করে ফেলা হচ্ছে একটি নিকৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। আর ইডেনে পড়াশোনা করা ছাত্রী মানেই দুশ্চরিত্রা! দুর্ভাগ্যজনকভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এ সরলীকরণ। ট্রল হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ইডেন মানে বেহেস্তের বাগান। এ বাগানে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোকে চূড়ান্ত বিবেচনা বা অগ্রাহ্য করা কোনোটাই কি সঠিক হবে? কলেজটির সব ছাত্রী বা অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাই এমন-এ ধরনের সাব্যস্ত করে ফেলাও কি সঠিক হবে?
বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা পূর্বকালের ছাত্রলীগ আর স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ছাত্রলীগ এক নয়। দুই পর্বের ছাত্র লীগের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্য যেমন আদর্শের দিক থেকে রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতাকর্মীদের স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে। অবস্থার দৃষ্টে বলাই যায়, সংগ্রামশীল, আদর্শ ও নৈতিকভাবে বলবান, মানবিক, সহৃদয় ও দায়িত্বনিষ্ঠ একটি ছাত্র সংগঠন তার চরিত্র হারিয়েছে। ছাত্রলীগ এখন একটি ভীতিকর নাম। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপরাধ ও গর্হিত কর্ম নেই, যার সঙ্গে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। এখন ছাত্রলীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মীদের অর্থ-বিত্ত-বৈভরের শেষ নেই। যেটা অতীতের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কল্পনায়ও আনতে পারেনি। বর্তমানদের লোভ, ঈর্ষা, দখলদারি মনোভাব এতই বেড়েছে যে, অর্থ-মোক্ষ অর্জনের জন্য তারা যাচ্ছেতাই করতে পারে। ক্ষমতা ও প্রভাব রক্ষায় আপন সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হতে, খুন-জখম করতে তাদের হাত এতটুকু কাঁপে না। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ-সংঘাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত কর্মী নিহত ও আহত হয়েছে। দেশে গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করছে। কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে। শুধু কিশোর গ্যাং নয়, কিশোরী গ্যাংও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও।
আগেও কখনো কখনো ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত দেখা যেতো। ছোটখাটো মারামারিও ক্ষেত্রবিশেষ হতো। কিন্তু ছাত্রীরা মারামারি করেছে, এমনটি কখনওই দেখা যায় নাই। এখন ছাত্রীরাও মারামারিতে পিছিয়ে নেই। ইডেন কলেজের উদাহরণ তো সামনেই আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ মারামারির নজির তো রয়েছেই।
এমতাবস্থায় কেন দু’চারটা উচিৎ কথা বলছেন না বুদ্ধিজীবী আর অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা? কেন কিছু বলছেন না আদর্শবান সাবেক ছাত্রলীগের নেতারা? যতক্ষণ না নিজের সন্তান বা বোন ধর্ষিতা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি কি আসতে নেই? তারা কেন বলছেন না দোষীদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হোক।
আগেই বলেছি, আজ যারা ছাত্রলীগ করছে, তাদের সুযোগ-সুবিধার অন্ত নেই। গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। সেই হিসাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই সময়কালে চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বা থাকবে, ততদিন এই প্রাধান্য অটুট থাকবে। ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-চরিত্র তাদের কর্ম বা পেশাজীবনে প্রতিফলিত হবে, এটাই সংগত। পর্যবেক্ষক মহল শংকিত এই ভেবে যে, প্রশাসন, আইনশৃংখলা বাহিনী এবং শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারা নিয়োগ পেয়েছে বা এখনো পাচ্ছে, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও মান সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এমতাবস্থায়, আগামীতে দেশ কেমন চলবে, আন্দাজ করা অসম্ভব নয়। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
এদিকে ইডেনের হিডেন অবস্থা উপলব্ধির পথে নতুন খোরাক জুগিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনায় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ১২ নেত্রী সম্প্রতি ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আমরণ অনশন করতে। প্রথমে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশের সময় বাধাপ্রাপ্ত হন বহিষ্কৃত এই নেত্রীরা। এরপর প্রতিবাদের মুখে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে আবার গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে ১ ঘণ্টা অবস্থান করার পর বাইরে বেরিয়ে আসেন তারা। তাদের এ ভূমিকা ও অবস্থানও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, সিট বাণিজ্য, সাধারণ ছাত্রীদের হেনস্তাসহ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে দুপক্ষেরই।
এতো কিছুর পরও সভাপতি সম্পাদককে কমিটিতে রেখে সহ-সভাপতিসহ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা এবং কমিটি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সংকট আর সাধারণ ছাত্রীদের ও ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে না। বরং এতে সমস্যা ও নির্যাতন নতুন মাত্রা পাবে। এই ধরনের সংকট নিরসনে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা বরাবরই অনুপস্থিত। কারণ মূলধারার রাজনীতি এই সংকট জিইয়ে রাখে তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।
যে কোনো সমস্যা থেকে উত্তরণ বা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সমস্যাকে স্বীকার করে নেওয়া, তার মাত্রা কম বা বেশি যেটাই হোক। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদের দায় বেশি। অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধেই বেশি। কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, গোটা রাজনীতির জন্যই এটি কলঙ্কের। উদ্বেগ-শঙ্কারও। কে জানে এদের মধ্যেই রয়েছে কিনা আগামীদিনের কোনো মন্ত্রী-এমপি? বা ভবিষ্যৎ পাপিয়া-সাবরিনা? কী দশা হবে তখন? সরকার যাবে, আসবে। কিন্তু যে সরকার সব ক্ষেত্রে অগ্রসরমান, শান্তিপূর্ণ, সুশাসিত দেশ রেখে যাবে, সেই সরকারই ইতিহাসে নন্দিত হবে। এই জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয়টি সামনে রেখে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিজ্ঞজনদের মতে, বর্তমান ছাত্রলীগ সরকারের জন্য এখন আর সম্পদ নয়, বোঝাস্বরূপ। তাই এ বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে। একটা পরিশোধন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।