Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনীতিতে সম্ভাবনার সঙ্গে আশঙ্কাও রয়েছে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:২১ এএম

জনশক্তি ও পোশাক রফতানি বৃদ্ধি দেশের জন্য সুখবর। চলতি বছরের বিগত মাসগুলোতে উভয় খাতে রফতানি বেড়েছে। জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে অন্তত ৭ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। গত বছর একই সময়ে হয়েছিল ২.৫৩ লাখ কর্মীর। সউদী আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। সেখানে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৪.২৭ লাখ। সউদী আরব ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্দান, কাতার, কুয়েত ও লেবাননে গেছে বাংলাদেশি কর্মী। করোনা অতিমারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনীতিসহ খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পতিত হলেও মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর জন্য হয়েছে শাপেবর। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও গতি পেয়েছে। আগামীতে ওইসব দেশে জনশক্তি আমদানি এখনকার মতোই অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটাও কম সুখবর নয়। সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ প্রভূত লাভের ভাগী হতে পারে। পোশাক রফতানিতেও তেজি ভাব দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। উভয় বাজারেই রফতানি বেড়েছে। জানুয়ারি-জুন সময়ে ইউরোপে বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এই বাজারে বাংলাদেশ চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানিতে চীন এক নম্বর দেশ। বাংলাদেশ দ্বিতীয়। অবশ্য উভয়ের ব্যবধান বিশাল। বিশ্ববাজারে ৩৮ শতাংশ পোশাক রফতানি করে চীন। আর বাংলাদেশ করে ৬.৮ শতাংশ। বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সুবাদে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বাড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে উভয় বাজারে, যদি বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে পারে। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিং সম্প্রতি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের মতোই ‘স্থিতিশীল’ থাকতে পারে। সংস্থাটি এই বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশের জন্য ‘বিবি মাইনাস’ রেটিং বহাল রেখেছে।

এসব তথ্য-পরিসংখ্যান ও আশাবাদ স্বস্তি যোগালেও আশঙ্কার দিক মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এটা সত্য, করোনা মহামারি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সেভাবে নাড়াতে পারেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধও অনেক দেশের চেয়ে কম প্রতিক্রিয়া ফেলেছে এখানে। তবে বিশ্লেষকদের অভিমত, যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশ এর মারাত্মক প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। ইতোমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় রকমে আঘাত লেগেছে। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে রীতিমত চিড়ে-চ্যাপ্টা। মধ্যবিত্তরা অবস্থান হারাতে বসেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ আত্মরক্ষার ঝুঁকিতে পড়েছে। তাদের সম্পদ-সঞ্চয় ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সকলেরই জানা, সঞ্চয়পত্রের লাভে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবননির্বাহ হয়। তারাও সঞ্চয়পত্র ভেঙ্গে খাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে এসে ঠেকেছে। আগস্ট মাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮ লক্ষ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র। অথচ, গত বছর আগস্টে বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। ওদিকে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব অর্থনীতির প্রায় সকল খাতে প্রতিফলিত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া রোধে ডলারের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। এতদিন জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে অর্থনৈতিক সাফল্যের যে ডংকা বাজানো হয়েছে, সেটাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির কাঠামো নড়বড়ে, মোটেই টেকসই নয়। অবিলম্বে তা সংস্কার না করলে ২০৩৫-৩৯-এর মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনটি বাধার কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ন প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। বিশ্বব্যাংক কিছু পরামর্শও দিয়েছে। যেমন, রফতানি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে বলেছে, শুল্কহার কমাতে বলেছে, ব্যাংক খাতের সংস্কার চেয়েছে।

অর্থনীতির সম্ভাবনা ও সংকটাশঙ্কার এই প্রেক্ষাপটে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বড় একটি আশঙ্কার খবর দিয়েছে। তার সমীক্ষায় বিশ্বের ২২ জন সরকারি-বেসরকারি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের বরাতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে আরো একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা হতে পারে। আর ফ্লোরিডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘নেড ডেভিড রিসার্চে’র মতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ৯৮.১ শতাংশ। বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে কবে নাগাদ শেষ হবে, তা বলার উপায় নেই। মন্দার প্রভাব বিশ্বের সব দেশেই পড়বে। মন্দা দীর্ঘ হলে প্রভাবের মাত্রা বেশি হবে। বাংলাদেশও মন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। তাই ভবিষ্যতের আশঙ্কিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। অর্থনীতিকে একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়া করাতে হবে, যাতে যে কোনো আঘাত সহ্য করার সক্ষমতা তার থাকে। এটা কারো অজানা নেই, জনশক্তি ও পোশাক রফতানি আমাদের অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভ। এত কিছুর পরও যে অর্থনীতি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েনি, সেটা এই দুই স্তম্ভের কারণেই। স্তম্ভ দুটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। জনশক্তি রফতানি বাড়াতে হবে, সংখ্যায় ও গুণগত মানে। একইভাবে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের রফতানি বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে উৎপাদনশীল খাতে, যাতে কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে কালবিলম্ব না করে সংস্কারে হাত দিতে হবে। দুর্নীতি নিরোধ করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি ও ব্যয় রহিত করতে হবে। সাশ্রয় কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপ নেয়া হলে আশঙ্কিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সহজ হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনীতি

৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ নভেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন