পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিকতার অধঃপতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী-উভয়ের মধ্যে এ অধঃপতন বিস্তার লাভ করেছে। বলা হয়, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষার পাশাপাশি সততা, সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সহৃদয়তা, শালীনতা ইত্যাদির চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই শিক্ষকদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এজন্য শিক্ষকদের সর্বক্ষেত্রে আদর্শস্থানীয় হওয়া আবশ্যক ও জরুরি। ওদিকে অধ্যয়ন বা শিক্ষাকে তপস্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়। শিক্ষার্থী তাপসতুল্য। সব সৎ গুণাবলীতে ভূষিত করে গুণবান মানুষ হওয়া শিক্ষার্থীদের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অতীতে আমাদের দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই চারিত্র্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ করা যেতো। এখন দুঃখজনকভাবে এই লক্ষণ কমই দেখা যায়। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, শিক্ষার্থীর সঙ্গে অশোভন আচরণ, এমন কি ধর্ষণ, আর্থিক জালিয়াতি, গবেষণায় চুরি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, রাজনৈতিক দাস্যবৃত্তি ইত্যাদির অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে দলবাজি, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ, কিশোর গ্যাং কালচার মাদক সেবন ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণিত তথ্যাদির অভাব নেই। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ সহজেই লক্ষণীয়। এখন শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে। যাদের টাকা আছে তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় শিক্ষা কেনা সম্ভব। কোচিংবাণিজ্যের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এজন্য শিক্ষকরা তাদের দায় এড়াতে পারবেন না। ছাত্র-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার, উত্ত্যক্তকরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি অভিযোগে অনেক শিক্ষকের বহিষ্কার ও শাস্তি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অর্থ তসরুপ, গবেষণার নামে চুরি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদির জন্য বহু শিক্ষকের শাস্তি হয়েছে। গত ১০-১৫ বছরে সর্বক্ষেত্রে দলবাজদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য সরকারি চাকরিবাকরি, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দলদাসদের প্রাধান্য ও প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তাদের এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকদের মতো শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দলদাস্যতা প্রবল। এই সূত্রেই বিভিন্ন চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। কিশোর গ্যাং কালচার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গ্যাং সদস্যরা এমন অপরাধ নেই, যা করছে না। ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত মাদকের বিস্তার ঘটেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মাদকে আসক্ত হয়ে জীবনকে উৎচ্ছন্নের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে শোচনীয় অবস্থা ও অধঃপতন, তার জন্য রাজনীতি বিশেষভাবে দায়ী। ক্ষমতাসীনদের সব কিছু দখলের রাজনীতি থেকে শিক্ষাও মুক্ত নয়। শিক্ষক ক্ষমতাসীন দলের হতে হবে। এজন্য দলীয় আদর্শানুসারী ও দলানুগত হওয়াই যথেষ্ট। নিয়োগপ্রত্যাশীরা শিক্ষকের মেধা, যোগ্যতা দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সততা, সচ্চরিত্রতা ইত্যাদির তেমন প্রয়োজন নেই। যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের রয়েছে নিয়ামক ভূমিকা। দলের লোক পদের অনুকূলে চাহিদামত অর্থের যোগান দিতে পারলে নিয়োগ নিশ্চিত। নিয়োগের ক্ষেত্রে এহেন অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির কারণে উপযুক্ত প্রার্থী কমই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। অযোগ্য, অদক্ষ ও অর্থশালী প্রার্থীই নিয়োগ পায়। আর নিয়োগ পেয়েই তার প্রধান কাজ হয় উৎকোচ হিসাবে দেয়া টাকা ওঠানো। এই মনোভাব সক্রিয় হওয়ার পর তার আর নীতি-নৈতিকতা ও সততার কোনো বালাই থাকে না। ঘুষ, দুর্নীতি, আর্থিক জালিয়াতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হয়। কথায় বলে, আদর্শবান ও উপযুক্ত শিক্ষকই যথাযথ শিক্ষিত, মেধাবী, সৎ ও চরিত্রবান মানুষ গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষকের নৈতিকতা ও সততা যখন অপূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত তখন শিক্ষার্থীও সেই মানেরই হবে। গাছ যেমন, ফল তো তেমনই হবে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে কয়েকজন শিক্ষককে জড়িত থাকার অভিযোগ আটক করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক দুঃখ করে বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের, শিক্ষককে অ্যারেস্ট না করে পারিনি। আমি কার ওপর বিশ্বাস করবো। প্রশ্নপত্র আনা-নেয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম তিনিই ফাঁস করলেন।’ সচিবের এই খেদ ও দুঃখ, কেবল তার নয়, গোটা দেশের মানুষের। বলা বাহুল্য, যেসব শিক্ষকের নৈতিকমান এই পর্যায়ের, তারা কী শিক্ষা দেবে, আর শিক্ষার্থীরাই বা কী শিখবে? এ ধরনের শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীরা যদি গ্যাং কালচারে অভ্যস্থ হয়, মাদকে চুর হয়ে থাকে, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে কি তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায়?
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিদ্যার্জনের পাশাপাশি সততা, সত্যবাদিতা ও চরিত্রের অন্যান্য মহৎ গুণাবলী অর্জনের জন্য শিক্ষকদের যে ভূমিকা ছিল, নিজেদের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার যে প্রবণতা ছিল, এখন তা প্রায় নিঃশেষিত হতে বসেছে। চরিত্রকে আদর্শায়িত ও গুণান্নিত করার জন্য পাঠ্যসূচীতে নানা বিষয় ও প্রসঙ্গ আগে যুক্ত ছিল, যা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতো, এখন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঠ্যসূচী থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষার বিষয় ও প্রসঙ্গগুলো বাদ দেয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৈতিকশিক্ষা লাভের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতন দ্রুতায়িত হয়েছে। আগের দিনে পরিবারে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, তাও নানা কারণে কমে গেছে। এর ফল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বেরিয়ে আসছে, সেই শিক্ষার্থীরা না যথার্থ শিক্ষিত, না আদর্শবান ও চরিত্রবান। এ অবস্থা জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক আশঙ্কার বিষয়। আজকে যারা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী, তারাই আগামী দিন জাতিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে, পরিচালনা করবে। তারা যদি যোগ্য না হয়, সততায় উত্তম না হয়, চরিত্রে বলিষ্ঠ না হয়, তাহলে জাতির ক্ষতি ও বিপর্যয় কেউ রোধ করতে পারবে না। বিশেষজ্ঞ-পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এই পরিস্থিতির আশু অবসান কাম্য। এজন্য প্রথমত, শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব রহিত করতে হবে। মেধা-যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। ঘুষবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দলীয়করণ ও দলবাজি বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সব কিছু দখল করার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। তৃতীয়ত, পাঠ্যসূচীতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা ব্যাপক আকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান হয়ে আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিকে পরিণত হতে পারে। বর্তমান সরকার কী রেখে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটা আলোচনায় আসবেই। কাজেই, সরকারকে এমন কিছু রেখে যেতে হবে, ভবিষ্যত প্রজন্ম যা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।