পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান ঘটেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। এক সময় বলা হতো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। সেই সাম্রাজ্য, জৌলুস এখন গল্পের বিষয়। তবে রানীর একটা বিশেষ সম্মান ছিল। তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে তার ইতি ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে জানানো হয়, তিনি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। সেই সময় থেকেই তার স্বাস্থ্য নিয়ে বৃটেনের জনগণের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়। রানীর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসদে জড়ো হওয়ার পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার কিছু আগে ঘোষণা করা হয়, তিনি দুপুরে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বৃটেনের জনগণের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে শোকেবিহ্বল মানুষ জড়ো হতে থাকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদসহ বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানরা রানীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তারা রানীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। গতকাল বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এ তিন দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
রানী এলিজাবেথ ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল আলেকজান্দ্রা উইন্ডসর-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অ্যালবার্ট ছিলেন ডিউক অফ ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ-লিওন। রানি এবং তার বোন দুইজনই লেখাপড়া করেছেন বাড়িতে। তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উইনস্টন চার্চিল যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় তার পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর জুন মাসে ২৫ বছর বয়সে বাবার উত্তরাধীকারী হিসেবে এলিজাবেথ ব্রিটেনের রানীর দায়িত্ব লাভ করেন। যুদ্ধের পর ব্রিটেন তখন কঠিন অর্থিনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করেছিলেন, রানী এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহনের মধ্য দিয়ে ‘নতুন এলিজাবেথান যুগ’ শুরু হলো। সেই থেকে ৭০ বছর তিনি রানী ছিলেন। মাত্র ৭ মাস আগে তিনি রাজসিংহাসনে আরোহনের ৭০ বছর পূরণ করেন। ৭ দশক এবং ৯৬ বছর বয়স পর্যন্ত রাজকর্ম পরিচালনা করা এক বিরল রেকর্ড। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। ব্যক্তিগত জীবনে রানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা উত্থান-পতন দেখেছেন। আধুনিক যুগে ব্রিটেনের প্রভাব কমলেও রানী এলিজাবেথ ছিলেন সারাবিশ্বের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও শ্রদ্ধার পাত্রী। ব্রিটেন ছাড়াও তিনি ছিলেন ১৪টি দেশ ও অঞ্চলের রানী। তিনি ছিলেন, ৫৪ সদস্যের জোট কমনওয়েলথের প্রধান। এদেশগুলোর অধিকাংশই অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এককথায় তিনি ছিলেন, বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ। তাঁর অধীনে ব্রিটেনের ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত মঙ্গলবার মৃত্যুর আগে তিনি লিজ ট্রসকে নিয়োগ দেয়ার ৪৮ ঘন্টা পর মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২ জন প্রেসিডেন্টকে তাঁর প্রাসাদে স্বাগত জানিয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলে ৯৯ বছর বয়সে রানীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু হলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কিছুদিন ধরে তার স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সমস্যা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নিয়োগের আগে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের বিষয়টি ঐতিহ্যগতভাবে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে হলেও বরিস জনসনের বিদায় এবং লিজ ট্রসের নিয়োগের আনুষ্ঠানিকতা স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রতি রানী এলিজাবেথের অফুরন্ত ভালবাসা ছিল। তার ভালোবাসার পথ ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশে একবার এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বর চারদিনের সফরে এসেছিলেন। সে সময় তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পাশাপাশি ঢাকা থেকে ট্রেনে শ্রীপুর এবং সেখান থেকে গাড়িতে করে গাজীপুরের বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে যান। তার আগমন উপলক্ষে সে সময় গ্রামটির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। কাঁচা রাস্তা রাতারাতি পাকা হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের একটি কাঁঠাল বাগানে গ্রামের নারীদের সঙ্গে তিনি গল্প করেছিলেন। এ সময় রানীকে এক নারী রূপার একটি প্রতীকি চাবি উপহার দেন। এর অর্থ তিনি যেকোনো সময় এ গ্রামে আসতে পারবেন। এলিজাবথ একাধিকবার সংকটের মুখে পড়েছিলেন। বিশেষ করে পারিবারিক সংকট। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দেয় তার ছেলে চার্লস যখন যুবরাজ ছিলেন, তখন এক দুর্ঘটনায় রাজকুমারী ডায়ানা মৃত্যু হয়। ডায়ানার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে চার্লসের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে ক্যামিলার সাথে প্রণয়কে কেন্দ্র করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রানীকে তখন যথেষ্ট কৌশলী হতে হয়। এরপর রানির আরেক ছেলে রাজকুমার এন্ড্রুর উচ্ছৃঙ্খল জীবন নিয়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় রানী বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন। একইভাবে রানির নাতি প্রিন্স হ্যারির অশ্বেতাঙ্গ প্রেমিকা মেগান মরকেলকে নিয়ে নানা ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা রাজতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও রানী তা ভালোভাবে সামাল দিতে সক্ষম হন।
রানীর মৃত্যুর পর কে দায়িত্ব নেবে তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। চার্লসের বয়স যখন ৩ তখনই ঠিক করা হয়েছিল তিনি হবেন রানীর উত্তরসূরী, ব্রিটেনের রাজা। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলাকে পূর্ণ রানী না বলে কুইন কনসর্ট-এর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। রানীর মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যের আয়োজন কিভাবে হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা আছে। শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হবে ১০ দিন পর লন্ডনে। আগামী ১০ দিন লন্ডন, এডিনবরা, কার্ডিফ ও বেলফাস্টে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। গতকাল দুপুরে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে ও সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে ঘন্টা বাজানো হয়। হাইড পার্ক ও টাওয়ার হিলে আনুষ্ঠানিকভাবে কামান দাগিয়ে সম্মান জানানো হয়। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে রানী যেসব দেশের রানী ছিলেন ( যেমন অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা), সেসব দেশের নেতাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজপরিবারের প্রতিনিধি এবং সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। রানী এলিজাবেথ যেমন বর্নাঢ্য জীবনযাপন করেছেন, তেমনি বিশ্বের দেশগুলোর কাছে সম্মান ও ঐক্যের প্রতীক ছিলেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে রাজপরিবার যাতে চিরস্থায়ীভাবে ভালোবাসার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়, এজন্য তিনি সারাজীবন সচেষ্ট ছিলেন। পরিশেষে আমরা রানী এলিজাবেথের জীবনাবসানে গভীর শোক এবং রাজ পরিবার ও ব্রিটেনের নাগরিকদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।