Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য

| প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রায় তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে একটি হাই প্রোফাইল সফর হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংশিত ইস্যু থাকলেও দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মোদি বৈঠকে যে ৭টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নেই। তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের পুরনো প্রত্যাশা ও উদ্বেগের বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে সমঝোতা স্মারকে সীমান্ত নদী কুশিয়ারা থেকে পানি প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের আধুনিকায়ন-উন্নয়ন, বাংলাদেশের জুডিসিয়াল অফিসারদের ভারতে প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে সহযোগিতা ও ইন্ডাসট্রিয়াল রিসার্চ বিষয়ক সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে, তা দুই দেশের শীর্ষ নেতার হাই প্রোফাইল দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বা সম্পৃক্ততা অপরিহার্য নয়। এসব সমঝোতা মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও হতে পারত। তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বা বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের উপর ভারতের এন্টি-ডাম্পিং শুল্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো ছাড়াও এ সময়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি শেয়ারিং, নেপাল-ভুটান থেকে কম দামে বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতের সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয় এই সফরে অনালোচিত-অমীমাংশিত থাকা আমাদের জন্য হতাশার বিষয়।

আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি ও নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিশেষত ৫৪টি অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদীর পানির অংশীদারিত্ব এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার উপর আমাদের কৃষিব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা, যোগাযোগব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। গঙ্গার পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং তিস্তার উজানে বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে গড়িমসি বাংলাদেশকে একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত একযুগে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যতগুলো হাই প্রোফাইল সফর বিনিময় হয়েছে সবগুলোতেই তিস্তার পানিবণ্টনকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্যতম প্রত্যাশিত ইস্যু হিসেবে গণ্য করা হলেও ভারতের পক্ষ থেকে অবিশ্বাসের মূলা ঝুঁলিয়ে বলা হয়েছে, শীঘ্রই তিস্তা চুক্তি হবে। এবার যেন তার ব্যতিক্রম দেখা গেল। এবার দুই নেতার বক্তব্যে তিস্তা চুক্তির কথা না থাকলেও ঢাকায় প্রকাশিত পত্রিকার সংবাদ শিরোনামে শীঘ্রই তিস্তাচুক্তির আশাবাদ প্রকাশিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জবানিতে। বাংলাদেশের জন্য বহুল প্রত্যাশিত-কাক্সিক্ষত ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে অগুরুত্বপূর্ণ ৭টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর বরাবরের মতো মোদি এবারো বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে সুরমা-কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারের সুযোগ এ দেশের মানুষ মেনে নেবে কীভাবে?

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে ঘিরে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় যেসব রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ এসেছে তার মধ্যে প্রকাশ্য এজেন্ডার চেয়ে অপ্রকাশ্য রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি মোদি সরকারের সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রত্যাশার বিষয়টিও প্রকারান্তরে উঠে এসেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মোদির অবস্থানও রাখঢাক ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে। তিনি একাত্তরের আদর্শে মৌলবাদী শক্তিকে মোকাবিলার কথা বলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভারতের বর্তমান সরকারের অবস্থান আবারো নিশ্চিত করেছেন বলেই ধরে নেয়া যায়। আন্তদেশীয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সমঝোতা বা বোঝাপড়া খুব ভঙ্গুর একটি বিষয়। সম্পর্ক হতে হয়, দুই দেশের সাধারণ মানুষের বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের নিরিখে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন নিশ্চিত করা ছাড়া সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে ধরনের মনোভাব দেখায়, ভারত এসব বিষয়ে নিস্পৃহ থাকতে পারে না। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নবাদিতা দমনে সহযোগিতা, প্রায় বিনা মাশুলে বহুল প্রত্যাশিত স্থল ও নৌ ট্রানজিটসহ বাংলাদেশের বন্দর, রেল ও সড়কপথ ব্যবহার করার সুযোগ দান, দেশে বিশাল জনশক্তিকে কর্মহীন রেখে ভারতীয় কর্মীদের শত শত ডলারের রেমিটেন্স পাঠানোর সুযোগ প্রদান করেছে বাংলাদেশ অবলীলায়। অথচ, বাংলাদেশ বিনিময়ে কিছুই পায়নি। এখনো সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না, বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না, তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিশ্চিত হচ্ছে না। বিষয়গুলো দুই প্রধানমন্ত্রীর সমঝোতা ও আলোচনার এজেন্ডায় অনুপস্থিত থাকা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ কী পেল, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। কাজেই, পানি, জ্বালানি, খাদ্য ইত্যাদির নিশ্চয়তায় বিকল্প পথ বা উপায় অবলম্বন করতে হবে। ভারতের ওপর বা মোদির ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমাতে হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
আরও পড়ুন