পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অবশেষ চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা বাগান মালিকদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। মজুরির সঙ্গে আনুপাতিক হারে অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। বৈঠকের পর আসা নতুন মজুরির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে চা শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তাই শ্রমিকরা কাজে ফিরে এসেছেন। আবার কোনো কোনো শ্রমিক নেতা এখনও মনে করেন, নতুন যে মজুরির ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেটি পুরো সন্তোষজনক নয়।
শেষ হয়েও হচ্ছিলো না চা শ্রমিকদের আন্দোলন। যেন, জিইয়ে রাখা হচ্ছিলো আন্দোলনটি। রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে পড়ার মতো অবস্থা যাচ্ছিল চা বাগানগুলোতে। পারলে জাতিসংঘকে ডেকে নিয়ে আসার উপক্রম চা বাগানের বিচার করতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, ডান-বাম মিলিয়ে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম চলছিলো সমানে। মালিক, শ্রমিক, শ্রমিক নেতাসহ নানাপক্ষেও ভিন্ন দল-উপদল। কারও প্রতি কারও বিশ্বাস নেই। রাতে নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলে যাচ্ছে ভোরে। সকালে আরেক দফারফা। দুপুরেই আরেক দৃশ্যপট। পক্ষ-বিপক্ষ ওলট-পালট।
কার্যত দুই বছর পর পর ‘চা সংসদ’ ও ‘বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়। সবশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। আর নতুন চুক্তি না হওয়ায় সে থেকেই শ্রমিকরা তাদের মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ ১৩৪ টাকার প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘট শুরু। কিন্তু সময়টা বড় খারাপ। দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার যুক্তিগ্রাহ্য দাবিতেই চলমান আন্দোলনটির শুরু শোকের মাস আগস্টের ৯ তারিখে। ১১ আগস্ট পর্যন্ত মোটামুটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে চলে শ্রমিকদের কর্মবিরতি। এর মাঝে প্রশাসন, মালিক, শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও পঞ্চায়েতপ্রধানসহ নানাপক্ষীয় দেনদরবার হয়। সমাধানের কাছাকাছি অবস্থাও তৈরি হয়। পরক্ষণেই তা বাতিল করে ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট।
সময় যত গড়ায়, তত বাড়তে থাকে নানাপক্ষের সম্পৃক্ততা। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার শর্তে ও মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাসে একটা ফয়সালায় চলে আসে তারা। জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে দ্রুত কথা বলবেন। ওই পর্যন্ত শ্রমিকরা আগের ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজ করবেন। কিন্তু দুপুরে শ্রমিকদের একাংশ বিগড়ে যায় বা তাদের বিগড়িয়ে দেওয়া হয়। শোকের মাসের আরেকটি শোকাবহ তারিখ ২১ আগস্টেও বৈঠক বাদ পড়েনি। রাতে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চা শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠকে ছিলেন জেলা প্রশাসক, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, চা শ্রমিক নেতা, চা শ্রমিক ইউনিটের বিভিন্ন কমিটি, পঞ্চায়েতপ্রধানদের বাইরে সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। প্রায় দুই ঘণ্টা চলে বৈঠকটি। সেখানে চা শ্রমিকদের কর্মবিরতিসহ আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। শ্রমিকদের এও জানানো হয়, তাদের চলমান আন্দোলনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। অচিরেই বাগান মালিকদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য বৈঠকে এর সমাধান হবে বলে আশ্বস্ত করা হয় তাদের। উপস্থিত চা শ্রমিক নেতারা এতে তাৎক্ষণিক সায় দেন। তবে সিদ্ধান্তটি পরে জানাবেন বলে বেরিয়ে আসেন। গণমাধ্যমে ততক্ষণে সংকট সমাধানের গরম খবর ছড়িয়ে পড়ে। খবরে জানানো হয়, দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ সামান্য কিছু পরই আবার উল্টো খবর। চা শ্রমিক নেতাদের বাগান মালিক ও সরকারের দালাল আখ্যা দিয়ে শ্রমিক ও পঞ্চায়েতপ্রধানদের একটি বড় অংশ থেকে আসে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা।
এই বিতিকিচ্ছিরি দশায় সারাদেশের বাগান থেকে চাপাতা উত্তোলন, কারখানায় প্রক্রিয়াজাত ও উৎপাদন বন্ধ। স্থবিরতা ভর করেছে দেশের চাশিল্পে। এখন চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। গাছে গাছে চায়ের সবুজ পাতা আর অঙ্কুরিত কুঁড়ি। কারখানায় নিয়ে এসব পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের এই সময় চাশিল্পের এ অচলাবস্থা বড় রকমের দুঃসংবাদ। ভরা মৌসুমে আন্দোলনের নামে এ স্থবিরতায় এরই মধ্যে চাশিল্পের যে ক্ষতি হয়ে গেছে, এর জের কতদিন টানতে হবে-এখনই সেটি বলা যায় না।
চা শ্রমিকদের পূর্বের ইতিহাসও অমানবিকতায় ভরা। বাংলাদেশ ও আসাম অঞ্চলে চা বাগানগুলোর প্রতিষ্ঠা হয় অষ্টাদশ শতকে। চীন থেকে ব্রিটিশরা প্রথম চায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রায় শত বছর পূর্বে চা উৎপাদনের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে চা শ্রমিকদের ধরে বেঁধে, লোভ-লালসা দেখিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের এখানে আসা ঠিক হয়নি-তখন তাদের চেতনা জাগ্রত হয়। তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরণ ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন।
সেই ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ সেনারা গুলি চালিয়ে শতশত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিল তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে চা শ্রমিকরা।
চা বাগান আলাদা একটা জগৎ! বাংলাদেশে চাশিল্পের ইতিহাস ১৬৮ বছর। এ শিল্পের ধরন ও বৈশিষ্ট্য অনেকেরই জানার বাইরে। এ কারণে চা বাগান ও চাশিল্প নিয়ে বেশিরভাগ খবরই একমুখী। ব্যবসা বা শিল্পটি বনেদি। লাভ বেশুমার। কর্মকর্তা ও শ্রমিক বেতনের তফাত বিস্তর। আবার এ ব্যবসা করতে গিয়ে লাটে ওঠার ঘটনাও বহু। লাভের অঙ্ক যেমন সফল মালিকরা জানান না। লোকসানের শিকাররাও নানা কারণে ব্যর্থতা না জানিয়ে বরং আভিজাত্য জানান দিয়ে স্বস্তি পান। আর ঐতিহ্যগতভাবেই টাকার অঙ্কে শ্রমিকরা মজুরি কম পান চা বাগানে। কিন্তু বাড়তি কিছু প্রাপ্তি আছে তাদের জন্য যেমন, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, রেশন, উৎসব ভাতা ইত্যাদি হিসাব কষলে একেবারে কমও নয়। এ ছাড়া আম, কাঁঠাল, আনারসসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি কিনতে হয় না তাদের। অফ সিজনে অন্য কাজের সুযোগও আছে।
চা বাগানে তিন শ্রেণির শ্রমিক কাজ করে। ‘এ’ ক্যাটাগরির শ্রমিকদের মজুরি ছিলো ১২০ টাকা। ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির শ্রমিকদের বেতন আরও কম। এ ছাড়া প্রতিটি বাগানে শ্রমিকদের স্থায়ী-অস্থায়ী ভাগও আছে। তাদের বেতন আরও অনেক কম। উৎসব ভাতা ও রেশন নেই তাদের। প্রায়ই মেলে না অতিরিক্ত কাজের মজুরিও। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ২০২১ সালে জারি করা ‘টি গার্ডেন’ গেজেটে চা শ্রমিকদের আবাসন, চিকিৎসা সুবিধা ফ্রি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি রেশন, মাতৃত্বকালীন ভাতা, গ্রুপ বীমা নিশ্চিতের উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬-এর ১০৮ ধারা অনুযায়ী আট ঘণ্টার বেশি কাজের জন্য শ্রমিককে অতিরিক্ত কাজের মজুরি দিতে হবে। তা চা শ্রমিকদের জন্যও প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে চা শ্রমিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। একজন কৃষি শ্রমিক সকালবেলা কাজ শুরু করলে দুপুর পর্যন্ত এক রোজ শেষ। আবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আরেকটি পর্ব থাকে। সাধারণ শ্রমিকরা যেখানে আট ঘণ্টা কাজ করে, সেখানে একজন চা শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ১২ ঘণ্টা (ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত)। অথচ এই শ্রমের বিনিময়ে সঠিক প্রাপ্তিটা নিশ্চিত হয় না।
সমাজের অন্যান্য মানুষের তুলনায় চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান যে নিম্নমানের, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। গেজেট অনুযায়ী চা বাগানের বিক্রয়লব্ধ মোট অর্থের শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ শ্রমিককে অংশগ্রহণভিত্তিক মুনাফার অংশ হিসেবে প্রতিবছর একবার প্রদেয় হবে। ওই হিসাবে ২০২১ সালের চা বিক্রির অর্থের শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ দাঁড়ায় ৯০ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু শ্রমিকদের পর্যন্ত সেটি কখনও পৌঁছায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালসহ শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশ চীন এবং কেনিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। ভারতে মজুরি কোনো জায়গায় ২৪০ রুপি আবার কোথাও ২০৩ রুপি, শ্রীলংকায় ৩৫০ রুপির মতো দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে এসচেয়ে কম।
এক তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার বা চট্টগ্রাম জেলার ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে বর্তমানে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ। তাদের অনেকেই বংশ পরম্পরায় এসব বাগানে নিয়োজিত রয়েছেন। কিন্তু এই শ্রমিকরা সবসময়ে এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। এখনো স্থানীয় বাঙ্গালিদের সঙ্গে তাদের ভাষা বা সংস্কৃতির দিক থেকে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ধারার কোনো ছাপ পড়েনা চা শ্রমিকদের জীবনে। তবে, গত পাঁচ বছরে চা শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে মাত্র ১৮ টাকা। এক কথায় এটি দুঃখজনক ও লজ্জার। প্রচার-প্রচারণাও দুঃখজনক। মালিকদের একতরফা রক্তচোষা আর শ্রমিকদের ক্রীতদাস ধরনের প্রচারণার নেপথ্যে রয়েছে নানা উদ্দেশ্য।
দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।