Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রাণপুরুষ নূরুল হককে স্মরণ করি

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে একদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে ক’জন শুভাকাক্সক্ষী বন্ধুর এক বৈঠকে কী একটি বিষয়ের উপর নিজের মতামত ব্যক্ত করে সংসদেরই প্রাণপুরুষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল ইসলাহ্ সম্পাদক নূরুল হক সাহেবকে তাঁর সাহিত্য পত্রিকায় আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, আপনি তো সবসময় বিশ্বের সমসাময়িক ঘটনা, পরিবেশ, সমাজ ও দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সুন্দরভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। আল ইসলাহ পত্রিকার একটি কলামে এসব বিষয়াদি নিয়ে লিখতে থাকুন, আমি স্পেস দেবো। আমি তখন বলেছিলাম, স্যার, বলা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়।

আমি সাহিত্যের ছাত্রও নই, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের। কিন্তু লেখার ভালমন্দ বুঝতে পারি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘পদ্য জিনিষটা সমুদ্রের মত, তার যা বৈচিত্র্য তা প্রধানতঃ তরঙ্গের। কিন্তু গদ্যটা স্থলসদৃশ। তাতে নানা মেজাজের রূপ নিয়ে আসা হয়। অরণ্য, পাহাড়, মরুভ‚মি, সমতল, প্রান্তর, কান্তার ইত্যাদি ইত্যাদি। জানা আছে পৃথিবীর জলময় রূপ আদিম যুগের; আর স্থলের আবির্ভাব হাল-আমলের। সাহিত্যে পদ্যটাই প্রাচীন, গদ্য ক্রমে ক্রমে জেগে উঠেছে। তাকে ব্যবহার করা- অধিকার করা সহজ নয়, সে তার আপন বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না। নিজের শক্তি প্রয়োগ করে তার উপর দিয়ে চলতে হয়। ক্ষমতা অনুসারে সে চলার বৈচিত্র্য কত তার ঠিক নেই- ধীরে ধীরে ছুটে চলা, নেচে চলা, তার পরে না চলারও। কত আকার কত রকমের শোয়া, বসা, দাঁড়ানো।’ মাত্র ২৯ বছর সময়ে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লিখেছেন, তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, ‘এখন ভাষার প্রতি লেখকদের আর প্রেমিকের মতো দৃষ্টি নেই। নিতান্তই ভৃত্যের দৃষ্টিতে তারা ভাষাকে দেখে থাকেন, এখন বাংলা ভাষার গতি বেড়েছে, শব্দ সম্পর্কে বেড়েছে কিছু নমনীয়তা। কিন্তু বলেন্দ্রনাথের ভাষায় যে আভিজাত্য, যে মহিমাময় পদক্ষেপ, যে উদার আড়ম্বর দৃষ্ট হয় তা লোপ পায়নি। ভাষার সে রাজকীয়তা আর নেই, ভাষা এখন নির্বাচনোত্তীর্ণ এম.এল.এ স্তরে বিচক্ষণ কারিগরের স্তরে নেমে এসেছে। ভাষা এখন ভাব প্রকাশের যন্ত্র মাত্র, ভাষা আর স্বপ্রতিষ্ঠা নয়, হয়ত কালের গতিতে ইহাই অনিবার্য। রাজকীয় কালের সঙ্গে রাজকীয় ভাষাও চলে গেছে...।’
অন্যদিকে অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, একটি শব্দও এত শক্তিমান হতে পারে যে, হাজার বছর ধরে মানুষের শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। একটা বাক্যের জন্য হয়ত একটা যুগ অপেক্ষা করছিলো। যেই ওটি উচ্চারিত হলো এমনি মানুষ পেয়ে গেলো তার ভাবনার কণ্ঠস্বর। একটি আইডিয়াও ইতিহাসে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। বলা বাহুল্য ‘অপ্রিয় হলেও সত্য’ লিখতে গিয়ে যতসব অপ্রিয় প্রশ্নের অবতারণা অনেকের কাছে ধান ভানতে শীবের গীত মনে হয়েছে। একটি লেখার মধ্যে যদি ভাব ও ভাষা সমৃদ্ধ নতুন আইডিয়া থাকে, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের কিছু ইঙ্গিত থাকে, অবিচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কষাঘাত থাকে তবে সে লেখার স্থায়িত্ব ও আবেদন বেশি হয়। জানি আমাদের মতো সাধারণ সাংবাদিক ও কলাম লেখকের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। তবুও ভাবতে আপত্তি কী?

সে যাই হোক, পরম শ্রদ্ধেয় নূরুল হক সাহেব উৎসাহ দিতে শুরু করলেন, আর আমি লিখতে শুরু করলাম। লেখার বিষয়বস্তু ও জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে নিজের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও প্রচুর বই কিনতে শুরু করলাম। কিন্তু এত বই কোথায় রাখা যায়, এও এক সমস্যা। অবশেষে আমি আমার সহধর্মীনির সঙ্গে পরামর্শ করে যেখানে বসে পড়ালেখা করি সেখানে ও ড্রইং রুমকেই বই রাখার জন্য নির্ধারণ করেছিলাম, এটা এখনও বলবৎ আছে। আমি খুশি যে আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে এখন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার বই রয়েছে। কোনো এক লেখকের কথা মনে পড়লো বারবার। তিনি বলেছিলেন, দেয়ালে হাজার টাকার একখানি নোট না ঝুলিয়ে হাজার টাকা দামের একখানি ছবি ঝুলানোতে যে অধিক সুরুচির পরিচয় দেয়, তেমনি নানা বর্ণের নানা লেখকের রাশি রাশি বই সারি সারি বই সাজিয়ে রাখাতে প্রমাণ হয় যে গৃহকর্তা একাধারে ধনী ও গুণী। এরপর এ লেখকই অন্যত্র লিখেছেন, যতদিন না বাঙালি সমাজ নিজেদের পাঠক হিসাবে না দেখে পুস্তক ক্রেতা হিসাবে দেখতে শিখবেন, ততদিন বঙ্গ সাহিত্যের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না। লেখক বই ক্রেতাকে ধনী ও গুণী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু যারা ধনী তারা বই কিনেনই না, পড়াতো দূরের কথা। ধনী না হলেই বই কেনা ও বই পড়া যাদের অভ্যাস তারা বই কিনেন ও পড়েন। আর বই কিনে যারা পড়েন না তারা নিশ্চয়ই নিজেদেরকে গুণী হিসাবে প্রচার করার জন্য বই কিনেন। সে যাই হোক, আবার ড্রইং রুমে ফিরে আসি। ড্রইং রুম যখন আস্তে আস্তে বই ও বইয়ের আলমীরা দ্বারা ভর্তি হতে লাগলো তখন পরিবারের অন্যান্যের মধ্যে অসন্তোষ লক্ষ করলাম। কেউ কেউ মৃদু আপত্তিও করতে লাগলেন। তাদের ধারণা, বই ও আলমীরা দ্বারা ড্রইং রুমের সৌন্দর্য শোভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি পরিবারের সবাইকে বইয়ের উপস্থিতি, প্রয়োজনীয়তা সুস্থ পরিবেশের সহায়ক ইত্যাদি অনেক কিছুই বুঝাতে চেষ্টা করলাম, এখনও করছি। বুঝতে বাকি থাকছে না যে, বই এখন অনেকের শত্রæ। আমার পরে যে এগুলো এ ড্রইং রুমে থাকবে না তাও বুঝতে বাকি নেই। তবে এ ব্যাপারে আমার নির্দেশ রয়েছে।

এর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা প্রত্যক্ষ করে প্রচুর আনন্দ পেলাম। আমার এক প্রতিবেশী বন্ধুর ছেলেকে প্রায় দু’মাইল পথ পায়ে হেঁটে কলেজে যেতে দেখে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা তুমি তো অবস্থা সম্পন্ন ঘরের ছেলে, পায়ে হেঁটে কলেজে যাচ্ছ কেন? মা কি রিকশাভাড়া দেন না? ছেলেটি বললো, চাচা, মা রিকশা ভাড়া দিয়েছেন ঠিকই, আমি এ টাকা জমিয়ে রাখছি বই কেনার জন্য। ক’দিনের রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে সে টাকা দিয়ে আমি বই ক্রয় করি। বললাম, তোমার মা-বাবা কি বই ক্রয় করার জন্য টাকা দেন না? সহজ সরল উত্তর, দেন, কিন্তু আমি চাই কিছু কষ্ট করে পায়ে হেঁটে সে কষ্টের টাকা দিয়ে বই কিনি এবং ইতোমধ্যে এভাবে বেশ কিছু বই কিনেছি। পড়াও হয়ে গেছে কেনা অনেকগুলো বই। আমি শুনে মুগ্ধ হলাম। রিকশার ভাড়া বাঁচিয়ে বই কেনা, এটা একটা মহৎ অভ্যাস। এ ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যাসের জন্য ছেলেটার প্রশংসা করতেই হয়। আজকে আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি আমার শ্রদ্ধেয় শুভাকাক্সক্ষী নূরুল হককে, যিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ দিয়ে লেখকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ করেছেন। তিনি আমাকে সব সময় সৎ উপদেশ দিতেন। আন্তরিকভাবে আমার মঙ্গল কামনা করতেন। বিনয় এবং সহিষ্ণুতা তার কাছ থেকেই শিখেছি। সাহিত্য সাধনার নিরলস কর্মী, প্রচার বিমুখ এই বিরল ব্যক্তিত্ব ১৯৮৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরের দরগা মহল্লা, ঝরনার পারস্থ তাঁর নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

একদিন আমি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বেশ আঘাত পেয়ে ক’দিন বিছানায় শুয়েছিলাম। একটি লেখায় তার উল্লেখও করেছিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে একদিন সাক্ষাৎ হলে আমাকে বললেন, ‘তুমি যে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়ে ক’দিন বিছানায় শুয়েছিলে তাতো আমাকে জানাওনি, তোমার এক লেখায় সে সংবাদ পেলাম।’ আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এ প্রশ্নের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। আমার চোখে পানি আসতে দেখে বললেন, ‘কেঁদোনা আমি তো তোমার শুভাকাক্সক্ষী, মঙ্গলাকাক্সক্ষী, তোমাকে স্নেহ করি, নিজের ছেলের মতোই।’ হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে যে, আমার প্রতি তাঁর স্নেহের অন্ত ছিল না। তাঁর মতো ধীর, স্থির, সংযতবাক, মহৎপ্রাণ মুরব্বী আর ক’জনই বা আছেন সমাজে। আমরাও তো আর ছোট নই, জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত প্রায়।

আজকের এই পড়ন্ত বিকালে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমার বাবা আব্দুস সোবহান চৌধুরীকে, যিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া কালে কলকাতার ‘পয়গাম’ নামক পত্রিকা প্রতিদিন আমার হাতে দিয়ে পড়তে পরামর্শ দিতেন। আর ঐ সময় থেকেই আমার শুরু। আমি দেশ-বিদেশের কম করে হলেও ১২টা পত্রিকায় লিখি আর পড়ি প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি পত্রিকা। আমি আনন্দিত এজন্য যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমার ২৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও ক’টি বই প্রকাশের অপেক্ষায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন