Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জানুয়ারিতে গতি বাড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগে

৩ রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ বিতরণ ৬ মাস বন্ধ থাকায় বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি কমেছে : বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ২০ গুণ

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের : আগামী জানুয়ারি মাস থেকেই দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে ব্যাপক গতি আসছে। কারণ, ঋণ বিতরণ বন্ধ থাকা তিনটি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক জানুয়ারি থেকেই ব্যাপক হারে ঋণ বিতরণ শুরু করবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক সংস্কার শুরু হবে ওই মাস থেকেই। এসব কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেসরকারি বিনিয়োগে জানুয়ারি থেকেই ব্যাপক গতি আসতে শুরু করবে। এদিকে বিদেশি বিনিয়োগে ব্যাপক গতি এসেছে। এবছর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে গতবছরের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে।
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমেছে। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত জুন মাস থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী ও রূপালীর ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ রয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোতে বন্ধ থাকবে ঋণ বিতরণ। পুরো ব্যাংক খাতের এক তৃতীয়াংশ ঋণ বিতরণ করে থাকে এই তিনটি ব্যাংক। তিনটি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও আলোচ্য সময়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ বেড়েছে যেটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, গত জুনে বেসরকারি খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৮০ হাজার কোটিতে। ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়লেও প্রবৃদ্ধি কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১.৩৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৬৩ শতাংশ।
তিনটি বৃহৎ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ থাকার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত জুন মাস থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শূন্য ছিল ব্যাংকগুলো। ওই সময় এমডি না থাকায় ব্যাংকগুলো কোন ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের শুরুতে শীর্ষ নির্বাহী পায় ব্যাংকগুলো। নতুন এমডিরা দায়িত্ব নেয়ার পর পুরো মনোযোগ দেন খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে। ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থ আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করছেন তারা। এক্ষেত্রে তারা সাফল্যও পাচ্ছেন। আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন ঋণ বিতরণ শুরু কারার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিন এমডি। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তারা শাখা ব্যবস্থাপকদের এ তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম ও রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এবছর বেসরকারি বিনিয়োগে যে ব্যাপক গতি আসছে তা বোঝা যাচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির চিত্র দেখলেই। এ বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে গতবছরের এই সময়ের তুলনায় ১২০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৬ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার। আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমার পরও মূলধনী যন্ত্রপাতির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বৃদ্ধির পেছনে ‘অর্থ পাচারের গন্ধ’ পাচ্ছেন অনেকে। তবে তাদের সন্দেহ উড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জুলাই-আগস্ট সময়ে যে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে সেগুলোর ঋণপত্র খোলা হয়েছিল এপ্রিল-জুন সময়ে। তাই অর্থপাচারের কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে, এই ধারণা ভুল। তবে কিছু যে অর্থপাচার হচ্ছে, তা তারা অস্বীকার করেন নি।
শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিই বাড়েনি, বেড়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পরিমাণও। এ বছরে জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৩১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকার। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পরিচালক জায়েদ বখত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেন, ‘এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি ও কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে দেশে বিনিয়োগ বাড়া। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়া। সেটাই হচ্ছে।’
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বড় প্রমাণ, তিনটি বৃহৎ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ থাকার পরও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ খুব একটা কমেনি। গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। জুলাইয়ে তা সামান্য কমে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকায়। আগস্টে আবার বেড়ে প্রায় ছয় লাখ ৭২ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, বৃহৎ ব্যাংক তিনটিতে ঋণ বিতরণ অব্যাহত থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি বাড়তো।
এদিকে জানুয়ারিতে বেসরকারি বিনিয়োগে ব্যাপক গতি আসবে সে বিষয়ে সরকার খুবই আশাবাদী। কারণ, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রক্রিয়া সহজ করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করতে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বিনিয়োগের বাধা চিহ্নিত করে এসব বাধা দূর করার উপায় সম্বলিত একটি প্রতিবেদন ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দিতে। প্রতিবেদনের আলোকে জানুয়ারি থেকে বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে এক ছাদের নিচে এনে দেয়া হবে ওয়ান স্টপ সার্ভিস, যেটা জানুয়ারিতেই চালু হবে।
এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর তরল অর্থও আছে। ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রেকর্ড ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও উন্নতি হয়েছে। নেই রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিরোধী দলের দায়িত্বশীল মনোভাবের কারণে আপাতত এর কোন শঙ্কাও নেই। তাই দেশে বিনিয়োগে বিপ্লব না আসার কোন কারণ দেখছে না সরকার।
এ বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আগামী বছরের শুরু থেকেই বিনিয়োগে বিপ্লব আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই। দেশে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে।’
বিদেশি বিনিয়োগেও রেকর্ড
শুধু দেশি বিনিয়োগেই গতি আসেনি, বিপ্লব ঘটতে চলেছে বিদেশি বিনিয়োগেও। চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিবন্ধন হয়েছে। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শতভাগ বিদেশি এবং দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগের ১৪০টি প্রকল্পে ৮৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকার (১ হাজার ১১৬ কোটি ডলার) বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বিনিয়োগ প্রস্তাবের এ পরিমাণ ২০১৫ সালের পুরো বছরের ২০ গুণ। গত বছর মাত্র ৪ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার (৫৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার) বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিডার সদস্য নাভাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, বাংলাদেশ এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সব সূচক ইতিবাচক। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে লাভজনক ও নিরাপদ মনে করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।



 

Show all comments
  • jaber ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫৫ এএম says : 0
    seta amader prottasa
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিনিয়োগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ