পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকার পক্ষের অনেক যুক্তি। ভর্তুকি কমানো, অর্থ পাচার বন্ধ সর্বোপরি বিশ্বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। আইএমএফের ঋণ চাওয়ার জন্য দাম বাড়াতে হয়েছে, এমন অজুহাতও রয়েছে। অর্থনীতি কম বোঝা মানুষও বোঝে, এগুলো যুক্তির নামে কুযুক্তি। আইএমএফের ঋণ বহু দেশই নেয়। তারা কি অজুহাত দেয়? বিশ্ব বাজারে ধারাবাহিকভাবে তেলের দাম কমছে। বহু দেশেই দাম কমানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দুই বাক্যের বিবৃতি কচিকাঁচার আসরের শিশুর মতো ঘোষণা আবৃতির মধ্যে মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন শেষে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, বাড়ানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, অস্বাভাবিক হচ্ছে দাম বাড়ানোর সময় ও রকমফের নিয়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের পড়তি দামের সময় বাংলাদেশে দাম চড়িয়ে দেয়া নিয়ে গোঁজামিল মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। সরকারের জন্য কি জরুরি ছিল? অথবা এর বিকল্প ছিল না? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অয়েল প্রাইস ডট কম বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলই বিক্রি হচ্ছে ব্যারেল প্রতি ৯৬ মার্কিন ডলারের নিচে। অন্যদিকে, অপরিশোধিত তেলের মিশ্রণ বা ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট বিক্রি হচ্ছে ব্যারেল প্রতি ৮৮ দশমিক চার শূন্য ডলারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের মতে, করোনা সংক্রমণ বাড়ায় বিভিন্ন দেশ আবারও লকডাউনে যাওয়ায় কমেছে তেলের চাহিদা। যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হ্রাস পাওয়ায় তেলের চাহিদা কমেছে রাশিয়া ও চীনে। পশ্চিমা দেশগুলোর আহ্বানে সরবরাহ বাড়িয়েছে সৌদি আরব ও লিবিয়া। এ পরিস্থিতিতে গত এপ্রিলের পর এবারই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ ক্রেতা দেশগুলোয় স্বস্তি ফিরবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের। এ বছরের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলারের বেশি ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এক পর্যায়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় একশ’ ৩৯ ডলারে। চলমান পরিস্থিতিতে ডিজেলের দাম কমায় বাসভাড়া ১১ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে পেট্রোল ও ডিজেল দুটোরই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ভারত। সরকারের দিক থেকে কেবল ভারতের উদাহরণ সামনে আনা হচ্ছে।
অথচ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) গত ৬ বছরে অন্তত ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এর মধ্যে সরকার নিয়েছে মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকার হিসাব কোথায় গেলো? সম্প্রতি জনগণের কাছে এই হিসাব তুলে ধরার দাবি জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ৩৬ হাজার কোটি টাকার হিসাব না দিয়ে বিপিসি বার বার লোকসানের দাবি করছে। বিপিসি’র দাবি ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপিসি কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে, সেটা জানা প্রয়োজন। আমরা বিপিসির পুরাতন হিসাবের খতিয়ান জানতে চাই। সারাবিশ্বের জ্বালানির চিত্র তুলে ধরে সিপিডি বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। অথচ, আমাদের দেশে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হলো। কেউ বলছে আমাদের দেশ থেকে নাকি অন্যদেশে কম। কিন্তু নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই। এ অবস্থায় বিপিসির উচিত পুরাতন হিসাবের খতিয়ান জনগণের সামনে প্রকাশ করার পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে, মূল্যবৃদ্ধি পুনর্বিবেচনা করে এটি কমিয়ে আনা। আর সরকারের উচিত খোলাবাজারে কম দামে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, রেশন কার্ডের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো, শুধু দরিদ্র নয়, নিম্ন আয়ের মানুষদেরও সংযুক্ত করা, মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া।
এর আগে সরকার, বিশ্ববাজারের কথা বলে বাড়ানো হয়েছে ভোজ্যতেলের দাম। ফায়দা লুটেছে মজুতদার-মুনাফাখোররা। আবারও দাম বাড়ানো হয়েছে। এদিকে ইউরিয়া সারের দাম কেজি প্রতি ৬ টাকা করা হয়েছে। ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে সম্পর্ক আরো অনেক কিছুর। পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে। তবে মূল ধাক্কা লাগবে কৃষি উৎপাদনে। ফসল উৎপাদনের আগে ও পরে ডিজেলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। এখন এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষিতে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, শঙ্কার বিষয়। কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তার বড়াইটি এখন কড়াইতে ওঠার পথে হাঁটছে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদনও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। রফতানি ব্যয় বাড়বে। জীবনযাপনে আরও বিপর্যয় নেমে আসার যাবতীয় লক্ষণ বিদ্যমান। বাজারে এমনিতেই মূল্যস্ফীতি। তা আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
আইলা বা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিও পুষিয়ে নিয়ে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু নিত্যপণ্যের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি কোথায় নেবে মানুষকে? কাঁচা মরিচ আক্রা, ডিমের হালি ৫০ টাকা, দাম বেড়েছে সব ধরনের সবজিরও। আরেক দফা দাম বেড়েছে মসলাসহ মুদিমালের। সেখানেও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত বিক্রেতাদের। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই তো চলছেই। করোনা মহামারির অজুহাত এখনো বন্ধ হয়নি। দুষ্টু প্রকৃতির দোকানদারদের লাউ-কুমড়ার বাড়তি দাম নিয়ে ডলারের দাম বৃদ্ধি, শাকের দামের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা বা পুঁটি মাছের দামের জন্য আইএমএফকে দায়ী করার এই রোগ সমাজের নানা মহলকেই আক্রান্ত করে বসেছে। পাওনা টাকা চাইতে গেলে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির অজুহাত। কেবল সরকারের ভেতরে নয়, অসাধু মনোবৃত্তির চর্চা সমাজের স্তরে-স্তরে ঢুকে পড়া বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সরকার বলছে, নিরুপায় হয়ে জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণ নিয়েও কথামালার শেষ নেই। যুক্তি-অজুহাতের পাশাপাশি যার মন যা চায়, তাই বলে দেয়ার সংস্কৃতি কেবল ডালপালা ছড়াচ্ছে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, এলএনজি, এলপিজি- সব ক্ষেত্রে সাপ্লাই পর্যায়ে উৎস থেকে শুরু করে একেবারে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত যত রকমের অপচয়-লুণ্ঠন রয়েছে তার সবই হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।