Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেখ হাসিনা কি ইন্দিরা গান্ধী হতে পারেন না?

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ : রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য শাখের করাত। তিন দিকে ভারত পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের জন্য শ্বাস নেবার মুক্ত জানালা দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ২৭২ কি.মি. মিয়ানমার সীমান্ত। ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসী নীতি বিশেষ করে অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদী নীতির তুফানে বাংলাদেশের ‘খড় কুটো’ এই সীমান্ত তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। ভারতকে এড়িয়ে স্থলপথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগেরও একমাত্র বিকল্প এই সীমান্ত। অন্যদিকে মিয়ানমারের জন্যও ভারতের মূল ভূখ- হয়ে পশ্চিমি দুনিয়ার স্থল যোগাযোগের সর্বোত্তম মাধ্যম বাংলাদেশ। এই যখন অবস্থা তখন দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক মধুরেনু হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা দাবা খেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে কখনো বসন্ত বাতাসের হিল্লোল পরিলক্ষিত হয়নি। বরং পৌষী-শীতলতা এবং থেমে থেমে কালবৈশাখী ঝঞ্ঝা পরিলক্ষিত হয়েছে। নৈর্ব্যক্তিকভাবে বললে বলতে হয়, এর জন্য বহুলাংশে মিয়ানমারের জাতীয় নীতিই দায়ী। বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রধান কাঁটার নাম ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’। এটা এমন এক সমস্যা যা বাংলাদেশকে গিলতেও বাধছে, উগড়াতেও।
জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেশী দেশের লাখ লাখ শরণার্থী গ্রহণ সম্ভব নয় এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতি পূর্ণ একটি দেশে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর অবস্থানের মতো ভূমির অভাব প্রকট। তাছাড়া ইতোপূর্বে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তারা স্থানীয় পর্যায়ে কিছু সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি করেছে। অফিসিয়ালি যাই বলা হোক, নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমন কখনো বন্ধ হয়নি। যখন ব্যাপকভাবে এসেছে কেবল তখনই গণমাধ্যমে ব্যাপক  ভাবে আলোচিত হয়েছে। এর বাইরে প্রতিনিয়ত দুই চার পাঁচ জন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে সব সময়। এদের মধ্যে ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গার শরণার্থী ক্যাম্পে ঠাঁই মিললেও বাকিরা ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। অনেকে আবার বিভিন্ন সূত্রে সরাসরি সমাজে মিশে গেছে। যারা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে তারাও ধীরে ধীরে ক্যাম্প থেকে সরে সমতলে মিশে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্যাম্পের মধ্যে বসবাসকারীদের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর দেয়া আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা কাজের সন্ধানে সমতলে এসে মূল স্রোতের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমন ও মূল স্রোত ধারায় মিশে যাওয়া নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের প্রবল বিরোধিতা রয়েছে। স্থানীয় বাঙালিদের অভিযোগ, যত্রতত্র রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে পর্যটন শহর কক্সবাজার এবং বিশেষ করে টেকনাফের সৌন্দর্য হারিয়ে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশী টাকার মান বেশী হওয়ায় রোহিঙ্গারা কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হওয়ায় স্থানীয় বাঙালি শ্রমিকেরা বেকারে পরিণত হচ্ছে। অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা অল্প মজুরিতে শ্রমিক পাওয়ায় বাঙালি শ্রমিকদের কাজে নিতে চান না। এদিকে সামাজিক নিরাপত্তার কারণে রোহিঙ্গা পিতামাতা তাদের কন্যাদের যে কোনোভাবে বাঙালি পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে আগ্রহী হওয়ায় অনেক ঘরে দ্বিতীয়, তৃতীয় স্ত্রী হিসাবে রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের প্রবেশ ঘটছে যা সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে এটা লক্ষ্য করা যায়। এতে স্থানীয়দের মনে ক্ষোভ বাড়ছে। বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের একাংশ মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ আছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশী শ্রম মার্কেট ভাগ বসাচ্ছে। এ ধরনের নানা কারণে স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তারপরও রোহিঙ্গাদের এই চরম দুর্দিনে বাংলাদেশের পক্ষে কি সম্ভব ‘দরোজা বন্ধ করে’ বা ‘মুখ ফিরিয়ে থাকা’? কিংবা মুখ ফিরিয়ে থাকলেই কি আমরা পার পেয়ে যাবো? বাংলাদেশ তো চেষ্টা করেছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দুর্গম সীমান্ত, দুর্বল নিরাপত্তা প্রহরা এবং দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে অসহায় রোহিঙ্গারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সংবাদপত্রের খবর, যতটা না গোপনে এসেছে, তার চেয়ে বেশী এসেছে স্থানীয় দালাল ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ঘুষ দিয়ে। সামাজিক গণমাধ্যমে এসব ঘুষ প্রদানের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। সামনে আরো আসবে তার আলামতও স্পষ্ট। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হলে চলবে না। কারণ এর সাথে বাংলাদেশের সুনামের প্রশ্ন জড়িত। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আরাকান থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়। দালালদের হাতে পড়ে শিশুরা পাচার হয়। কাজের লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। অনেক অভিভাবক ভবিষ্যতের শঙ্কা কাটাতে স্থানীয় বৃদ্ধদের সাথেও কিশোরীদের বিবাহ দিতে পর্যন্ত পিছপা হয় না। রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা যেন কোনোভাবেই নির্যাতনের শিকার না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি।
আরাকান শব্দটি এসেছে আরবী আল রুকুন শব্দ থেকে। তবে পি ফ্যায়রের মতে, প্রাচীন রাখাইং গোত্রের নামানুসারে এর নাম হয়েছে আরাকান। স্বাধীন আরাকান রাজ্যের শেষ রাজধানী ছিল ম্রোহাং। ম্রোহাংকে বাংলা কবিরা রোসাঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। এই রোসাঙ্গ থেকেই রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। আরাকানে রোহিঙ্গাদের রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। প্রাচীনকালে আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। এর আয়তন ছিল ২০ হাজার কি.মি.। তবে বর্তমানে এর আয়তন ১৪ হাজার বর্গ কি.মি.। প্রাচীনকালেই আরাকানে মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল। তখন আগমন ঘটেছিল আরব বণিকদের মাধ্যমে, কিছু জলদস্যু আক্রমণের শিকার হয়ে ও জাহাজ ডুবির শিকার হয়ে। পরবর্তীকালে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে বিপুল পরিমাণ মুসলিম আরাকানে প্রবেশ করে স্থায়ী বসতি গড়ে।
পঞ্চদশ শতাব্দী আরাকানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ শতাব্দীর শুরুতে আরাকান রাজ মিন সাউ মুন বার্মার উপর আক্রমণ পরিচালনা করে ব্যর্থ হন। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে বার্মা রাজ তার রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাকে বহিষ্কার করলে তিনি বঙ্গদেশে চলে আসেন। বঙ্গরাজার সহায়তায় ১৪৩০ সালে রাজা মিন সাউ মুন কয়েক হাজার মুসলিম সৈন্যের সহায়তায় পুনরায় আরাকান গমন করেন এবং যুদ্ধে বার্মারাজকে পরাজিত করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করেন। এ সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করে রাজা সুলাইমান শাহ নাম ধারণ করে রাজ্য পরিচালনা করেন। এ সময় আরাকান অনেকাংশে বঙ্গরাজের সালতানাতের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আরাকান রাজসভায় মুসলিম আমাত্যরা উচ্চপদ লাভ করেন। এদের একজন মাগন ঠাকুর। তার পিতা বড় ঠাকুর আল্লাহর কাছে অনেক মানত করে পুত্র লাভ করেন। তাই তার নাম মাগন রাখা হয়। মাগন ঠাকুর ইসলামের প্রথম খালিফা আবু বকরের (রা.) বংশধর। তার মন্ত্রিসভা অনেক বাঙালি কবি ও গুণী ব্যক্তি অলঙ্কৃত করেন। তাদের অন্যতম ছিলেন মহাকবি আলাওল। মাগন ঠাকুরের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগের বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পদ্মাবতী, সতী ময়না লোর চন্দ্রানী, সিকান্দার নামা, সায়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, তোহফা, হপ্ত পয়কর প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো এ সময় রচিত হয়।
১৭৮৫ সালে বর্মী রাজ বদা উপ্যা আরাকান দখল করে পুনরায় বার্মার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার আরাকানের জমিগুলো চাষযোগ্য করতে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু লোক আরাকানে নিয়ে যায়। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ¤্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। ইতোমধ্যে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্হ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থী অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল। জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গারে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল। জাপানী এবং বর্মীদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।
ব্রিটিশ আমলে মিয়ানমারে যখন আদমশুমারি হয় তখন ব্রিটিশ সরকার রোহিঙ্গাদের গণনা করেনি। রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু সেখান থেকে। স্বাধীনতার পর মিয়ানমার সরকার জাতীয়তার তিন স্ট্যান্ডার্ড দাঁড় করায়। উইকিপিডিয়ার তথ্যে জানা গেছে জাতীয়, সহযোগী ও আনুগত্যশীল -এই তিন প্রকারের নাগরিকত্বের স্ট্যাটাস ঘোষণা করা হয়। যারা ব্রিটিশ শাসনের আগে এসেছে তাদের জাতীয় নাগরিক বলা হয়। স্বাধীনতার পর সহযোগী ও আনুগত্যশীল নাগরিকদের আবেদন করতে বলা হলে রোহিঙ্গারা তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ তারা আগে থেকেই সেখানে আছে। এই গণনার পরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে স্ট্যাটাসহীন হয়ে পড়ে।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তার বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।
১৯৭৮ সালে পরিচালিত কিং ড্রাগন অপারেশনে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। এদের মধ্যে ৩ লাখ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশে ফিরে যায়, ২ লাখ সৌদী আরব, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে চলে যায়। ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। এদের মধ্যে ২ লাখ রোহিঙ্গা দেশে ফিরে গেলেও মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিতদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে এমন অভিযোগে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে যায়। তাদের কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় দুইটি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। তবে এই ক্যাম্পের বাইরে আরো দুই লাখ রোহিঙ্গা নানাভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবী।
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাতে মংডুর বেশ কয়েকটি বিজিপি ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা হামলা করে ৯ বিজিপি সদস্যকে খুন, ৬৪ আগ্নেয়াস্ত্র ও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। মিয়ানমার সরকার এই হামলার জন্য রোহিঙ্গাভিত্তিক স্বাধীনতাকামী সংগঠন আরএসওকে দায়ী করে নতুন করে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা শুরু করে। হেলিকপ্টার গানশিপ, মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে এই হামলায় ইতোমধ্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এ ছাড়াও ১২ শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। শিশু ও নারীদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে। মিয়ানমারের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার এই হামলার খবর শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে বিভিন্ন তথ্য উপত্তের মুখে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবে তাদের মতে, এটা রোহিঙ্গাদের জাতিগত দাঙ্গা। এদিকে মিয়ানমারের নোবেল বিজয়ী নেত্রী সু চি এই হামলায় একেবারে নীরবতা পালন করায় বহির্বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে ব্যাপকভাবে। আসলে গণতন্ত্র আসলেও মিয়ানমার সরকার এখনো ব্যাপকভাবে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেনাবাহিনীর লে. জে. পদমর্যাদার একজন অফিসার। সেনাবাহিনী সুকৌশলে সু চির আন্তর্জাতিক শান্তিবাদী ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করে দিচ্ছে এটা তিনি বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না।
মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গা গণহত্যায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব রহস্যময় ও বেদনাদায়ক নীরবতা পালন করছে। জাতিসংঘসহ কোনো কোনো সংস্থা মুখ খুললেও যতটা কঠোর হলে মিয়ানমারকে এই হামলা বন্ধে বাধ্য করা যেত তা তারা করছে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ব্যারি গ্রসম্যান আমাকে মিয়ানমার সমস্যা ব্রিটিশের সৃষ্টি বলে দায়ী করে তা বন্ধে তিনটি উপায়ের কথা বলেন। তার মতে, এই মানবিক বিপর্যয় কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তিনটি উপায় অবলম্বন করতে হবে। ১. রোহিঙ্গা সমস্যাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ২. ইউরাথু ভিক্ষু ও তার ৯৬৯ আন্দোলনকে টেরোরিস্ট ঘোষণা করতে হবে এবং ৩. মিয়ানমারের থেকে সকল প্রকার সহায়তা বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসি, আরবলীগসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশ ও সংস্থা সমূহের নীরবতা নীল কষ্টের মতো মেনে নেয়া যায় না।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বাংলাদেশ চাইলেই রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না। রোহিঙ্গারা আসছে, অথচ বাংলাদেশ অফিসিয়ালি তা অস্বীকার করে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবী করার সুযোগ হারাচ্ছে। শরণার্থীদের প্রতিপালনে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে। কাজেই অবলিম্বে সরকারীভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমণের সত্যতা স্বীকার করে সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরতে হবে।
রোহিঙ্গাদের আগমন বাংলাদেশের জন্য যতই দুর্ভার হোক মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের সাগরে ঠেলে দিতে পারে না। বাংলাদেশ বারবার ঘোষণা করেছে, এ দেশের মাটিতে প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসীদের কোনো প্রশ্রয় দেয়া হবে না। কিন্তু রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী নয়, মানবিক বিপর্যয়ের শিকার এক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশই পারে স্বল্প সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তাদের মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। সিরীয় শরণার্থীরা যখন ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য এসেছিল তখন আমরা ইইউ রাষ্ট্রগুলোর মানবিকতা প্রদর্শন প্রত্যাশা করেছি। আজ রোহিঙ্গাদের সাথে কেন আমরা একই মানবিকতা প্রদর্শন করবো না? বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন ভারত আশ্রয় না দিলে বাংলাদেশীদের পরিণতি কি হতো তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের এই এক কোটি শরণার্থীই সেদিন ইন্দিরা গান্ধীকে বিশ্বমঞ্চে কথা বলা সুযোগ করে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা চাইলেই, বাংলাদেশের জন্য দুর্ভার হয়ে বসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রসঙ্গ টেনে ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কথা বলতে পারেন। এই শরণার্থীদের প্রতিপালনে ও ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে পারেন। একই সাথে রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা ও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। এতে বিশ্বনেত্রী হিসাবে তার ভাবমর্যাদা ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি পারেন না মানবিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজের ও দেশের জন্য গৌরবের সেই মহান উপলক্ষ হতে?
email: [email protected]



 

Show all comments
  • আজমল খান ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৪৯ এএম says : 0
    রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসি, আরবলীগসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশ ও সংস্থা সমূহের নীরবতা নীল কষ্টের মতো মেনে নেয়া যায় না।
    Total Reply(0) Reply
  • সোবহান ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫০ এএম says : 0
    অবিলম্বে সরকারীভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমণের সত্যতা স্বীকার করে সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল আলম ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫২ এএম says : 0
    তিনি যদি এটা করেন তাহলে রোহিঙ্গাদের দোয়ার পাশপাশি তিনি ইতিহাসে স্বরণীয় হয়ে থাকবেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Hannan ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫৩ এএম says : 0
    Very nice, logical and informative writing
    Total Reply(0) Reply
  • Nuruzzaman ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৩ পিএম says : 0
    যুক্তিযুক্ত এবং প্রতিপালনীয় বিষয় বটে! ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mirana ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৫৮ পিএম says : 0
    এতে বিশ্বনেত্রী হিসাবে তার ভাবমর্যাদা ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
    Total Reply(0) Reply
  • জোবায়ের ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:০৬ পিএম says : 0
    তিনি যদি এই কাজটি করেন তাহলে তাঁর পাশপাশি বাংলাদেশও অনেক সম্মানিত হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেখ হাসিনা


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ