পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কলকাতা বন্দর থেকে গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশের জাহাজ ‘এমভি রিশাদ রায়হানে’ ভারতের ট্রানজিটপণ্যের একটি চালান আসে মোংলা বন্দরে, যা ওই বন্দরে আসা এ ধরনের প্রথম চালান। অতঃপর আনীত ১৬ দশমিক ৩৮০ মেট্রিক টন লোহার পাইপ সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছায়। আর ৮ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের কাঁচামাল কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলসীমান্ত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আসামে। এভাবে ভারতের পণ্য বাংলাদেশের ভূমি, রাস্তা ও বন্দর ব্যবহার করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকে কানেক্টিভিটি, ট্রান্সশিপমেন্ট ইত্যাদি নাম দেয়া হলেও এটি আসলে করিডোর। ট্রানজিট ও করিডোরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশের ভূমি ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য নেয়াকে বলে ট্রানজিট। আর একই দেশের পণ্য অন্য দেশের ভূমি ব্যবহার করে ফের ওই দেশেই নেয়াকে বলে করিডোর। ট্রানজিট বা করিডোর কোনোটাই এক তরফা হতে পারে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ সংক্রান্ত যে চুক্তিটি হয়েছে, তার শিরোনামে ভারতের পণ্য ভারতে নেয়ার কথাই বলা হয়েছে। চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে এবং ভারতের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। চুক্তির আওতায় ভারতের পণ্য ভারতে যাওয়া শুরু হয়েছে ২০২০ সালের জুলাইয়ে। ওই সময় চারটি কন্টেইনার ভর্তি মালামাল নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। পরে সেই মালামাল ত্রিপুরা ও আসামে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন একে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট কার্যক্রম বলা হয়। এবারও সেটাই বলা হয়েছে। ইনকিলাবের খবরে জানা গেছে, শিগগিরই এই ট্রানজিট পুরোদমে চালু হবে। বাংলাদেশের কাছ থেকে এ সুবিধাটি ভারত বহু দিন ধরে চেয়ে আসছিল। নানা কারণে বাংলাদেশ সেটা দেয়নি। অবশেষে ২০১৮ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে পেয়েছে। ভারত এযাবৎ বাংলাদেশের কাছে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। বাংলাদেশকে বিনিময়ে কিছু দেয়নি। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ বার বার চেয়েও পায়নি। ভবিষ্যতে পাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। তিস্তা চুক্তির মূলা ঝুলিয়ে বহু বছর পার করে দিয়েছে। তিস্তা চুক্তিও তামাদি হয়ে গেছে। বাণিজ্য অসমতা হ্রাস কিংবা সীমান্তহত্যা বন্ধের বাংলাদেশের পুনঃ পুনঃ অনুরোধও চরম উপেক্ষার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ যদি ভারতের সঙ্গে সমভাবে দরকষাকষি করতে পারতো, নিজের স্বার্থ ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে পারতো তবে এমন বঞ্চনার সম্মুখীন হতো না।
উভয় দেশের সরকারি পর্যায় থেকে প্রায়শঃই বলা হয়, দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বাস্তবে একথার কোনো ভিত্তি নেই। যদি তাই হতো, তবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মরণের পানি সমস্যার এতদিনে একটা সমাধান হতো, বাণিজ্য অসমতা কমতো, সীমান্তহত্যা বন্ধ হতো। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রকৃত উন্নয়ন ও বিকাশ তখনই হয় যখন দুটি দেশ একে অপরের স্বার্থ, সুবিধা ও প্রাপ্তিকে ন্যায় ও ন্যায্যতার দৃষ্টিতে দেখে এবং সে অনুযায়ী কাজ বা আচরণ করে। দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে সমতা বজায় থাকলে সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে বাধ্য। আমরা বরাবরই লক্ষ করে আসছি, ভারত নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। প্রতিবেশী বা অন্যের স্বার্থকে গ্রাহ্য করে না। এ কারণেই তার কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই সুসম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক কিছুটা ভালো। সেটা বাংলাদেশ সরকারের কারণেই। জনগণ পর্যায়ে ‘ভারত প্রীতি’ শূন্যের কোঠায়। বিষয়টি দু’দেশের সরকারকেই বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে হবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যথার্থ উন্নয়নের উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত ও তার সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাকে ‘বিগ ব্রাদার’সুলভ মনোভাব ত্যাগ করে ‘বন্ধুসুলভ’ মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। সৎ প্রতিবেশীমূলক ও সার্বভৌম ক্ষমতার নীতি অনুসরণ করতে হবে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দেশ হিসাবে সব প্রতিবেশীই ভারতের কাছ থেকে সদ্ভাব, সদাচার, সহৃদয়তা ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
যা হোক, এখন থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সমতা ও সমদৃষ্টি অনুসারে পরিচালিত হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। মনে রাখতে হবে, একতরফা কোনো কিছু কল্যাণকর ও টেকসই হয় না। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমঅংশীদারিত্ব অপরিহার্য। ট্রানজিট বিষয়ক চুক্তি একমুখী ও বৈষম্যপূর্ণ। এর সংশোধন দরকার। উভয় দেশের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত হয়, সেটা নিশ্চিত হতে হবে। চুক্তিতে বাংলাদেশ তার বন্দর, সড়ক, নৌপথ ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেয়ার বিনিময়ে কী পাবে, সেটা ন্যায়সঙ্গত ও স্পষ্ট হতে হবে। একথা বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন দুই সমুদ্রবন্দরের যে সক্ষমতা তাতে ভারতের পণ্য কন্টেইনার বা জাহাজের চাপ নেয়া সম্ভব নয়। এদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং এ জন্য বড় রকমের বিনিয়োগ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সড়ক ও নৌপথের সক্ষমতাও যথেষ্ট নয়, যাতে ভারতকে এসব ব্যবহার করতে দেয়া যায়। পরীক্ষামূলক ট্রানজিট কর্মসূচী পরিচালনায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, রাস্তাঘাট, সেতু নৌপথের নাব্যতার ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এসবের সুরক্ষা ও মেরামতের জন্য প্রতিবছর প্রচুর অর্থের দরকার। এমতাবস্থায়, ভারতকে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দিতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন হবে, তার নিশ্চিত সংস্থান আগে হতে হবে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের লাভের বিষয় তো আছেই। এই যাবতীয় অর্থের যোগান ভারতের দিক থেকেই আসতে হবে। ভারতের পণ্য ভারতে যাওয়ার সুযোগ দিলে বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে পণ্য রফতানির সুযোগ হারাতে হবে। তার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে, সেটাও দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসে ভারত সফরে যাবেন। তার ওই সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একতরফা ট্রানজিটের বিষয়টিও গুরুত্ব সরকারে আলোচিত হবে বলে আমরা আশা করি। ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিয়েছে, অনেক কিছু ত্যাগ করেছে, আমাদের আশা, এই স্বার্থ দেখা ও ত্যাগ করা আর একতরফা হবে না। বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানকে বন্দর ব্যবহারসহ ট্রানজিট সুবিধা দিতে পারে। বাংলাদেশের সীমানা থেকে এই দেশ দু’টির অবস্থান খুব দূরে নয়। মধ্যবর্তী জায়গা ভারতের। ভারত এক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহারের সুযোগ দিলে বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান এই ত্রিদশীয় ট্রানজিট সহজেই কার্যকর হতে পারে। এ বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।