পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। চিকিৎসকদের কারো কারো মতে, আত্মহত্যা একটি রোগ বা রোগের জের। এককথায় রোগ বলে ফেললে আলোচনার জায়গাটা ছোট হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসা তো অবশ্যই থাকে, থাকা উচিত। সেইসঙ্গে ভাবনার বিষয়, কেন রোগটির বিস্তার বাড়ছে? মোটকথা আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বা করোনাকে কারণ হিসেবে চালিয়ে দিলেও যুক্তির অভাব হবে না। তবে, তা হবে ঘটনা পাস কাটানোর অপচেষ্টা। নানা বিশ্লেষণ ও কেসস্টাডিতে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, বেকারত্ব, পেশাগত অশান্তি, আর্থিক সংকট ইত্যাদি আত্মহত্যার পেছনের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দেশে গত কয়েক বছর ধরে আত্মহত্যার ঘটনা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর গত কয়েক বছর মানে করোনাকাল।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যু এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ। আর নানা ঘটনায় উদ্বেগ-আতঙ্ক আরো আগ থেকেই। ক্রমে তা কেবল বাড়ছে। করোনার ধকল কমে আসার পরও উদ্বেগ-অস্থিরতা কমেনি, বরং বেড়েছে। সেইসঙ্গে হতাশা, বিষণ্নতা ভর করেছে বেশ পাকাপোক্তভাবে, যার নানামুখী জেরে নানা অসুখ-বিসুখের সঙ্গে ধকল পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞরা একে আত্মহত্যার একটি কারণ বলে শনাক্ত করেছেন। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। সর্বশেষ এক গবেষণা বলছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা, ৫ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ ছোট বা মামুলি মনে হলেও ওই ব্যক্তির কাছে সেটি অনেক বড় কারণ। আর করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। যে কোনো নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্র ও পরিবার উভয়েরই।
কম বোধ-বুদ্ধি বা কম শিক্ষিত লোকেরা আত্মহত্যা বেশি করে বলে একসময় একটা কথার প্রচলন ছিল। কিন্তু, সাম্প্রতিক কেসস্টাডি তা বলছে না। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা কম নয়, বরং বেশি। সুশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিতরাও আছে এ তালিকায়। রয়েছে সমাজের নামী-দামী, প্রতিষ্ঠিত-সামর্থ্যবানরাও। এটিও গবেষণার একটি উপাদান হতে পারে। করোনা এবং করোনাপরবর্তী পৃথিবীতে শিশু থেকে বয়স্কসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে মানসিক-অর্থনৈতিক অশান্তি বেড়েছে তা নিয়ে বিতর্ক নেই। এটি স্বীকার-অস্বীকারের বিষয়ও নয়। অনেকে নিজ থেকেও এর চিকিৎসা নিচ্ছে। সরকারি হিসাব বলছে, পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে মহামারি শুরুর আগে যে-সংখ্যক রোগী ভর্তি হতো তার চেয়ে এখন মাসে গড়ে হাজারও বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের সবাই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নয়, নিজ গরজেও আসছে।
মহামারিতে চাকরি হারানো, আয়-রোজগার কমে যাওয়া, জীবিকা ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্বজনের মৃত্যু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে অনেকেই মানসিক বিপর্যয়ের শিকার। আরেক হিসাব বলছে, গত দুই-আড়াই বছরে করোনায় যে সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মারা গড়েছে আত্মহত্যায়। আত্মহত্যা নিয়ে দেশে প্রকাশিত গবেষণাগুলোর তথ্য হচ্ছে, এ সবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল কারণ পারিবারিক চাপ-অশান্তি- হতাশা-ক্ষোভ-লজ্জা। মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগাতার বন্ধের সময় ২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ছাত্র ৬৫ জন। আর ছাত্রী ৩৬। তাদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২-২৫ বছর বয়সীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা অনুযায়ী, সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর পারিবারিক সমস্যায় ১৯.৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ। পড়াশোনাসংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ শতাংশ এবং আর্থিক সমস্যাকবলিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বিষণ্নতা, ক্ষোভ-জেদ-লজ্জা যে কারণেই হোক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার এ প্রবণতা বড় রকমের অশনিসংকেত। পুলিশের মতো, একটি শৃঙ্খলিত-প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা আরো বেশি অশনিসংকেত। সরকারি হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে আত্মহত্যায় মৃত্যু ১১ হাজার। গত বছর মহামারিতে ১৪ হাজার মানুষের আত্মহত্যার বাইরে সাম্প্রতিককালে লাইভে এসে বেশ কয়েকজন শিক্ষিত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ভাইরাল হওয়া মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাবনাকেও গোলমাল করে দিয়েছে। বিষণ্নতা আত্মহত্যার প্রাথমিক ধাপ। শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় বিষণ্নতার বিস্তার রুখতে একতরফা বা একপক্ষীয় কোনো সমাধান নেই। দীর্ঘমেয়াদে তা কোথায় গড়াবে ধারণারও বাইরে। যদ্দুর সম্ভব সমাধান খুঁজতে হবে শর্টকাটে, মোটেই দীর্ঘমেয়াদে নয়।
অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া শিশুও এ তালিকাভুক্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে নানান কথা হচ্ছে পথে-ঘাটে-মাঠে।
আমাদের সামজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে চলছে দ্রুত, যা পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে বন্ধন। সবাইকে করে ফেলছে অতি মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক। তা মানসিক চাপ সহ্যের সক্ষমতাকে তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। এর অনিবার্য কুফল থেকে বাঁচার রাস্তা খোঁজা জরুরি। এনজাইটি, ডিপ্রেশন, আবেগীয় বিষয় এবং স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সমস্যাগুলো রুখে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে পারিবারিক-সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের বিষয়াসয় রয়েছে। বাংলাদেশে ঝিনাইদহকে আত্মহত্যাপ্রবণ প্রধান জেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেলাটিতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় চারশোর মতো মানুষ আত্মহত্যা করে। সেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেয়া নানা উদ্যোগ কিছুটা হলেও কাজে দিয়েছে। এ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও সংগঠনগুলোর অভিজ্ঞতা নেয়া যেতে পারে গোটা দেশের জন্য।
তাছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে একসঙ্গে মানসিকভাবে পাশে থাকতে হবে। শিশুদের মানসিক বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন- ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী সেসব চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।