পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে খ্যাত শিক্ষক সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, কেউ কেউ ঘটনা পরম্পরায় জেল-জুলুমের মুখোমুখি হয়েছেন, কোথাওবা কাউকে এমনকি চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা-প্রতিবাদ হয়েছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন। তবে, কার্যকারণ যাই হোক, মোদ্দাকথা এটাই দাঁড়ায় যে, সমাজে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বলে বিবেচিত আমাদের শিক্ষক সমাজের কিছু সদস্য শারীরিক-মানসিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন।
আমরা হর-হামেশা জপ করে আসছি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এ পৃথিবীতে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি ব্যতিরেকে কোনো জাতি উন্নতি করেছে, এমনটি কেউ কখনো শুনেনি। একারণে অনাদিকাল থেকে প্রত্যেক সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ কদর পেয়ে আসছেন। প্রাচ্য সমাজে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যে কতটা উঁচু তার একটি উপমা পাওয়া যায় মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের অভিব্যক্তিতে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতায়। সেখানে আমরা দেখি, মহাপ্রতাপশালী দিল্লীশ্বরকে তাঁর সন্তান তদীয় উস্তাদের চরণ নিজ হাতে ধৌত না করে কেবল পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন দেখে শিক্ষক মহোদয়কে ডেকে সন্তানের ভব্যতার প্রশ্নে হতাশা প্রকাশ করতে। আজও এ দেশ ও সমাজের বৃহৎ পরিসরে শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষার্থীদের নিকটই নন, তাদের অভিভাবকদের কাছেও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কেবল জ্ঞানের আদান-প্রদানই হয় না, এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমন একটি সমাজে আপনি যদি দেখেন, একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তাহলে চিন্তায় আপনার কপালে ভাঁজ পড়বে, এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
তাহলে কী এমন হলো যে, আমাদের মতো এমন একটি শিক্ষক-অন্তপ্রাণ সমাজে এভাবে হুট-হাট শিক্ষক নিগ্রহের হিড়িক পড়ে গেল? যে বিষয়টি এখানে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো, এধরনের ঘটনা কি আগেও ঘটেছে, নাকি ইদানিং হঠাৎ করে ঘটতে শুরু করেছে? বিষয়টি কি এমন যে, এসব আগে থেকেই চলে আসছে, ইদানিং এ ধরনের ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র? এমন নয়তো যে, শিক্ষকগণ ঠিক এরূপ শারীরিকভাবে নিগৃহীত হননি ঠিকই, তবে বহুকাল ধরেই তাদেরকে এক শ্রেণীর ছাত্র নামধারীর মন জুগিয়ে মান বাঁচিয়ে চলে আসতে হচ্ছে? বিষয়টি এমন নয়তো যে, সাধারণ শিক্ষকরা তো বটেই, এমনকি প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের আসন অলংকৃতকারী আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও রীতিমতো করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করতে বাধ্য হন? চালাক-চতুর আর বিচক্ষণ ব্যক্তিদের ব্যাপার-স্যাপার অবশ্যি আলাদা। তাঁরা এধরনের ছাত্রদের সাথে তেলে-তালে, ঝোলে-ঝালে মিলে-মিশে এমনভাবে সবকিছু চালিয়ে নিতে পারেন, যাতে আপাতদৃষ্টিতে এমনটিই প্রতীয়মান হতে পারে যে, ইধার কুচ মুশকিল নেহি। অনেকের চোখে এ ধরনের পারফরম্যান্স দক্ষ ব্যবস্থাপনার পরাকাষ্ঠা বিবেচিত হলেও এভাবে ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্নে পদে-পদে আপোস করে কিল খেয়ে কিল চুরি করার পেছনে যে গভীর বেদনা লুকিয়ে থাকে তা দিনের পর দিন বয়ে চলা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, খোঁজ নিলে এমন অনেক করিৎকর্মা গুরুদেবের খোঁজও মিলতে পারে, যারা তাদের নানা রকমের অনিয়ম ঢাকতে এবং অন্যায্য অভিসন্ধি পূরণ করতে এ ধরনের স্যাঙ্গাতদের অতি আদরে লালন করেন। এরা তখন একে অপরের দোসর রূপে মনিকাঞ্চন জোড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কখনওবা নানামুখী স্থানীয়-অস্থানীয় চাপের মুখে নিজেদের প্রটেকশনের জন্যেও স্কুল-কলেজের শিক্ষাগুরুরা স্ট্রাটেজিক কারণে এসব ছাত্রদের পালনে বাধ্য হন বলে অনেকের ধারণা। আবার কখনও এমনও দেখতে পারেন, ওই দুষ্টু ছোকরাগুলো স্রেফ ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে, আসল ঝামেলাটা গুরুদেবদের নিজেদের মধ্যেই, যারা একে অপরকে দেখে নেয়ার জন্যে ঐ ছোকরাগুলোর মাথায় তেল দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া, এমন পর্যবেক্ষণও আছে যে, প্রায়শ এলাকার বিগ ব্রাদাররাও তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব ছোকরার একটি গ্রুপকে লালন করে থাকেন।
তবে, যে বিষয়টি জরুরি তা হলো, এ ধরনের যে কোনো ঘটনাকে সিরিয়াসলি নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। উপরের আলোচনার আলোকে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক হবে না যে, অনেক জায়গায়ই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের জন্য একটি অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ চলে আসছে। তথাপি, বলা চলে, শিক্ষকদের কোনো মতে মান বাঁচিয়ে চালিয়ে নেয়ার মতো একটি ব্যবস্থা চলে আসছিল। এখন তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে, দুর্বৃত্তরা তাদের উপর গায়ে গতরে হামলে পড়তে শুরু করেছে? এটা কি আগে থেকে চলে আসা অবক্ষয়ের নতুন পর্যায়, নাকি এর সাথে নতুন কোনো উপাদানের সংযুক্তি ঘটেছে? এটি বুঝতে না পারলে এরকম ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকবে। সরল রৈখিকভাবে সবকিছুকে এক কাতারে না ফেলে প্রতিটি ঘটনার পক্ষপাতহীন চুল-চেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বুঝা দরকার, সমস্যা কি একমুখী, দ্বিমুখী না বহুমুখী। নিগৃহীত শিক্ষকগণ কি নিতান্তই নিগ্রহের শিকার, নাকি তাদের কারও কারও মধ্যে এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে, যা কোনো কোনো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সংঘটিত ঘটনার সাথে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন, সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষকগণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তাঁরা সাম্প্রদায়িক কারণে হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাঁরা তাঁদের কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলেও পাল্টা অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের একটি কলেজের অধ্যক্ষ স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা সত্য হলে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। অপরদিকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন শিক্ষককে হেনস্থা করার জন্য কোনো একটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে আনা হলেও ওটা আসল কারণ নয়, বাহানা মাত্র। স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্ন কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর রুষ্ট ছিল এবং তাঁকে শায়েস্তা করার একটি উপায় খুঁজে ফিরছিল। আবার এমনও দেখা গেছে, সংঘটিত ঘটনা আসলে কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষির ফল, কিন্তু এতে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
ঘটনা যাই হোক, জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনসমূহে শান্ত ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের ঐতিহ্যগত সম্মান ও মর্যাদা কেন আজ হুমকির মুখে তা নির্মোহ বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে এবং তা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংঘটিত ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে কার দায় কতটুকু তা নিশ্চিত করতে হবে। হীন রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস নিলে, অন্য কথায় উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলে, প্রকৃত সমস্যা ও এর আসল কার্য-কারণ অচিহ্নিত থেকে যাবে। এমনটি হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, কোনো সমস্যা প্রাথমিক অবস্থায় সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে তা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।