Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জেনারেল আইন উদ্দিন : আমরা তাকে স্মরণ করি

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.) | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৪ এএম

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আকাশে সমুজ্জ্বল অসংখ্য তারকার মধ্য থেকে আরো একটি খসে পড়লো। তিনি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইন উদ্দিন, বীর প্রতীক। গত ২ আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে গেলেন। ‘নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।’ [সুরা বাকারা - ২:১৫৬]

সামরিক বাহিনীর সুপরিচিত এ মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত। তাঁর অনবদ্ধ অবদান যেমন মুক্তিযুদ্ধে বিস্তৃত, তেমনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠনেও লক্ষণীয়। তিনি সামরিক আইনজ্ঞ হিসেবেও সকলের নিকট সম্মানিত ছিলেন। মহান এ বীর সেনানী ১৯৪৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার লক্ষিপুরের কুলিয়াচরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন জনাব সুরুজ আলী।

১৯৬৫ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ) ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালের ৮ মে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪ ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করেন। ৪ ইস্ট বেঙ্গল সামরিক বাহিনীতে ‘বেবি টাইগার’ হিসেবে পরিচিত। এ ইউনিটে তিনি লেফটেন্যান্ট ও পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে পল্টনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ এর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে। ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল খিজির হায়াৎ খান (অবাঙালি), উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। আরো ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা চালানোর জন্য সকল পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করছে এবং এরই অংশ হিসেবে ৪ ইস্টবেঙ্গলকে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে ইউনিটকে দুর্বল করার দুর্ভিসন্ধি বাস্তবায়ন করার জন্য বাঙালি অফিসারগণকে ব্যবহার করছে; মহান আল্লাহ তাদের পরিকল্পনাকে স্বাধীনতা অর্জনের অনুকূলে কাজে লাগান।

ইউনিটের ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ হিসেবে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের জন্য অস্ত্র-গোলাবারূদ, যানবাহন, সাঁজ-সরঞ্জামাদি, খাদ্য-সামগ্রী, রসদ ইত্যাদি যোগান দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। আর এ সুযোগটি তিনি শতভাগ কাজে লাগিয়েছেন তাঁর নিজের ইউনিটের বিচ্ছিন্ন হওয়া কোম্পানিগুলোকে সম্পূর্ণভাবে রণসজ্জায় সজ্জিত করে। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শাফায়াত জামিল ও অন্যান্য অফিসার ও জওয়ানগণ এ কারণেই বিপুল শক্তি নিয়ে শত্রুকে সহজেই ঘায়েল করতে পেরেছিলেন। বন্দি করতে পেরেছিলেন অবাঙালি অধিনায়ক, অন্যান্য অফিসার ও জওয়ানদের।

ইউনিট যখন সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও সিলেটে অবস্থান করছে, ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন একদিন পাকিস্তানিদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য দুই ছোট্ট মেয়েকে সেনানিবাসে ফেলে রেখে সাইকেলে করে সেনানিবাস হতে পালিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য। এ রকম ত্যাগের ইতিহাস আমাদের জাতির ক’জনের আছে?

অতঃপর ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন ৪ ইস্ট বেঙ্গল ও ২নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন অপারেশনে সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন। একসময় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম ইউনিট অর্থাৎ ৯ ইস্ট বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে মেজর পদে পদোন্নতি দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ৪ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি ও দক্ষ মুক্তিযোদ্ধাগণকে নিয়ে আইন উদ্দিন অতি অল্প সময়ে পল্টনের প্রতিষ্ঠা করেন এবং যুদ্ধপোযোগী হিসেবে গড়ে তোলেন। এরপর ৯ ইস্ট বেঙ্গল একর পর এক যুদ্ধ করে তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর কসবাকে তিনি হানাদার বাহিনীর দখল হতে মুক্ত করেন। এরপর একে একে মুক্ত করেন চন্দ্রপুর, লাকুমুড়া, কৃষ্ণপুর, বাগবাড়ি এবং কুমিল্লা শহর। মিরপুর মুক্তকরণেও তিনি অংশ গ্রহণ করেন। এভাবেই একদিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় মেজর আইন উদ্দিনের মতো আরো অসংখ্য বীর সেনানীর অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য।

দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি কঠিন পরিশ্রম করতে থাকেন সেনাবাহিনীর উন্নতির জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তারিখে তাকে ৪র্থ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ও বীরত্বসূচক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এরপর লে. কর্নেল, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন নবগঠিত সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীকে একটি শক্তিশালী অবয়ব দেয়ার জন্য। তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ যেমন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক, প্রশাসনিক স্কুলের কমান্ড্যান্ট, ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার, বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর উপমহাপরিচালক, ঢাকা লজিস্টিক এরিয়ার কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সামরিক ও বেসামরিক আইনের উপর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সর্বশেষ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯ পদাতিক ডিভিশন, যা ঘাটাইল সেনানিবাসে অবস্থিত। দীর্ঘ ত্রিশ বছর চাকুরি করার পর ১৯৯৬ সালের ১৪ জুন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
একটি আদর্শ ও সুখী পরিবারের জনক জেনারেল আইন উদ্দিন ছিলেন তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর বড় মেয়ের স্বামী একজন ব্যাংকার, আল-আরফাহ ব্যাংকের ডিএমডি, দ্বিতীয় মেয়ের স্বামী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুপরিচিত অফিসার লে. কর্নেল মেসবাহ রবিন (অব.), তৃতীয় মেয়ের স্বামী মেজর জাহেদ এবং একমাত্র পুত্র মুহাম্মদ ফখরুদ্দিন। আরো রেখে যান সাত প্রপৌত্র ও দুই প্র-প্রপৌত্র।

সবশেষে তিনি চির অবসর গ্রহণ করলেন এবং নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালার নিকট।

আমরা এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা।

লেখক: সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জেনারেল আইন উদ্দিন
আরও পড়ুন