পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, নৃতাত্তি¡ক, ও পর্যটন শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্যাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর আলাদা কদর রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িÑ এ তিনটি প্রশাসনিক জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। এর মোট আয়তম ৫,০৯৩ বর্গমাইল বা ১৩,১৮৪ বর্গ কি.মি.। চট্টগ্রাম বিভাগের এই এলাকা পাহাড় ও উপত্যকায় পূর্ণ বলে এর নামকরণ হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়-পর্বতে ঘেরা, গাছ-গাছালি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সেখানকার উপজাতীয় সমাজ-সংস্কৃতির জন্য এ অঞ্চল দেশ-বিদেশি সবার প্রাণ কেড়ে নেয়।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশকিছু জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তার মধ্যে বাঙালি ছাড়া বাকিরা উপজাতি। জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পরে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো বা মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, চাক, খুমী, লুসাই বা মিজো, কুকি বা চিন জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে। এরা মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত। এসব স¤প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গিয়ে পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশিরা বসবাস করে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক বাঙালি জনগোষ্ঠী মোঘল আমল বা ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাস করছে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের লোকজন আছে। কিছু ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানও আছে।
বাঙালির ছাড়া এ অঞ্চলে বসবাস করা অন্যান্য স¤প্রদায়ের আদিভূমি ভারত, মায়ানমার, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, চীন, থাইল্যান্ড। সময়ের বিবর্তনে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসবাস করছে। ব্রিটিশ আমলেই বিভিন্ন উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। ব্রিটিশ আমলের আগেও চাকমাদের আগমনের ইতিহাস জানা যায়। মূলত ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের আগমন ঘটে। তাদের আগমন সম্পর্কে নৃতাত্তি¡কদের দু’টি মতভেদ রয়েছে। একদল নৃতাত্তি¡ক মনে করেন, তাদের আগমন ঘটে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে। আবার অন্যদল বলেন যে, চাকমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার সাথে আসাম ও ত্রিপুরার চাকমাদের অনেক মিল আছে। সেজন্য, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে চাকমাদের আগমন হয়েছে বলে তারা মনে করেন। এছাড়া মায়ানমার থেকে বর্মীদের আক্রমণের শিকার হয়ে ১৭৮৪ সালে মারমারা বাংলাদেশে আসে। ত্রিপুরারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, ম্রোরা মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে আসেন। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের মতো বাদবাকি স¤প্রদায়ও বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত ও মায়ানমারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসে বসবাস করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মের দিক থেকে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরপরে রয়েছে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু ও ক্রামা ধর্মের অবস্থান। বাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগ মুসলিম। এছাড়াও বাঙালি হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম ও বডুয়ারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। উপজাতিদের মধ্যে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী বেশি। তারপরে হিন্দু, ক্রামা, প্রকৃতি পূজারি এবং ধর্মান্তরিত মুসলিমও আছে। একসময় এখানে খ্রিস্টান ধর্মের নাম গন্ধ না থাকলেও বর্তমানে বৃদ্ধির হারের দিক থেকে খ্রিস্টান ধর্মই অগ্রসর। খ্রিস্টান এনজিও ও মিশনারীদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবামূলক সুবিধা প্রদান ও ধর্মান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা বিভিন্ন উপজাতিকে খ্রিস্টান বানাতে সক্ষম হচ্ছে।
তাদের প্রচেষ্টাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উপজাতীয় স¤প্রদায় এখন খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক ব্যতীত অন্যান্য স¤প্রদায়ের জনগোষ্ঠী অধিকাংশই খ্রিস্টান। পাংখোয়া, বোম, লুসাই ও কুকি প্রকৃতি পূজারি এ জনগোষ্ঠীগুলো বর্তমানে শতভাগ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। খেয়াং, খুমী, ত্রিপুরারাও অধিকাংশ খ্রিস্টান। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী খুমী জনগোষ্ঠী বর্তমানে ৬২.৮% খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্মের হলেও বান্দরবানের প্রায় সবাই খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকে এখনো হিন্দু ধর্মের অনুসারী। প্রকৃতি পূজারি ম্রো জনগোষ্ঠী বেশিরভাগ ক্রামা ধর্মের অনুসারী হলেও অনেকে খ্রিস্টান, কেউ কেউ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। ধর্মের দিক থেকে চাকমা, মারমা, চাক, তঞ্চঙ্গ্যারা এখনও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে, এসব স¤প্রদায়ের লোকজনও খ্রিস্টান হচ্ছে। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হওয়া থেকে বাদ নেই বাঙালি জনগোষ্ঠীও।
ধর্মান্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এর ফলে নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর প্রথা, মূল্যবোধ, সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মান্তরের ফলে একটা জনগোষ্ঠীর কয়েক দশকের মধ্যে সংমিশ্রিত আত্মপরিচয় নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সাথে নতুন ধর্মীয় প্রথা-মূল্যবোধের একটা দ্ব›দ্ব তৈরি হয়। যার ফলে, নতুন ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে চলতে গিয়ে তাদের ঐতিহ্যের অনেক বিষয়কে বিসর্জন দিতে হয়। ক্রমান্বয়ে তাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ-সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠী এদেশীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত। এতে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক সংস্কৃতির প্রভাব। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপজাতিরা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পাশাপাশি আধুনিকতা ও তাদের বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রথা-মূল্যবোধের আলোকেই পরিচালিত হয়। তবে, যেসব উপজাতি খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা ক্রিস্টানিটির আলোকে নিজেদের পরিচালিত করতে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতির অনেক উপাদান, প্রথা ও মূল্যবোধের বিলুপ্তি ঘটাতে বাধ্য হয়। ফলে ঐতিহ্যের জায়গায় চর্চিত হয় খ্রিস্টান ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়। তবে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অনেক বিষয় দেউলিয়া হলেও কিছু উপাদান তাদের জীবনে মিশে আছে। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মান্তরিত উপজাতিদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সাথে খ্রিস্টান ধর্মের প্রথা-মূল্যবোধ, ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন পাওয়া যায়।
লেখক: ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।