হেপাটাইটিস ভাইরাসে বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। পৃথিবীবাসীর এক-তৃতীয়াংশ লোকের সেরোলজিক্যাল টেস্টে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের অতীত ও বর্তমান ইনফেকশনের আলামত প্রমাণিত। ৩৫-৪০ কোটি লোক বর্তমানে এইচবিএসএজির ভাইরাসের ক্রনিক বাহক (ডেভিডসন্স অ্যান্ড প্রাক্টিস অব মেডিসিন)।
আমাদের দেশে এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে চার লাখ শিশু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্মূলে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। ডায়ালাইসিস চলাকালীন হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশে দিন দিন বেড়ে চলছে। বেসরকারি হিসাবে হেপাটাইটিসে প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় দেশে। হেপাটাইটিস একটি নীরব ঘাতক। হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানে না যে, তার শরীরে এই ভাইরাস আছে।
বর্তমানে কর্মক্ষম অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সী পুরুষ ও নারীর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এ ছাড়া ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রজননে সক্ষম নারীদের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল প্রায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ৩৫ শতাংশ, ক্রনিক হেপাটাইটিসের ৭৫ শতাংশ, লিভার সিরোসিসের ৬০ শতাংশ ও লিভার ক্যান্সারের ৬৫ শতাংশের জন্য হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস দায়ী। লিভারের জন্য আরেকটি ক্ষতিকর ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস ‘সি’। লিভার সিরোসিসের ৩০ শতাংশ ও লিভার ক্যান্সারের জন্য ১৭ শতাংশ দায়ী হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস।
গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে মা এবং গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মায়ের অ্যাকিউট ইনফেকশন হলে জন্ডিসে মা ও গর্ভের শিশুও মারা যেতে পারে। গর্ভজটিলতায় সন্তান প্রসবের সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। লিভারের অবস্থা ভালো না থাকায় কিছু ওষুধ দেয়া যায় না। চিকিৎসাবিহীন থাকলে একপর্যায়ে মা লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের দিকে যেতে পারে।
২০১৮ সালে অধ্যাপক মো: শাহিনুল আলমের এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত জনসংখ্যা ৫ দশমিক ১ শতাংশ। দেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ৮৫ লাখ লোকের মধ্যে নারীর (২৮ লাখ) চেয়ে পুরুষ (৫৭ লাখ) এবং গ্রাম থেকে শহরের সংখা বেশি। এর মধ্যে চার লাখ শিশুও আছে।
হেপাটাইটিস নির্মূলে করণীয়
এর প্রথম ধাপ হলো- হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস ভ্যাকসিন প্রোগ্রাম সফল করা। এটি প্রতিরোধের জন্য ২০০৩ সালে ১২ এপ্রিল হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুর দেড় মাস, আড়াই মাস ও সাড়ে তিন মাস বয়সে টিকা দেয়া হয়। টিকাদান কর্মসূচিকে নি-িদ্র করার জন্য শিশু জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেয়ার সুপারিশ থাকলেও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভ্যাকসিন, হেপাটাইটিস ‘বি’ ইমিউনোগ্লোবিউলিন ও বিশেষায়িত পরীক্ষাগুলো সহজলভ্য করতে হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয় বলে এর ব্যয়ভার বহনে সহযোগিতা করতে হবে। আশার কথা, হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের আরোগ্য লাভকারী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। সব রকম অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ সহজলভ্য করা জরুরি। সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা উচিত। ব্লেড, রেজর, সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, সুঁই- এই জিনিসগুলো একবার ব্যবহার করতে হবে। তা হলে এই ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে পারব।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে রক্তের পরীক্ষাগুলো যেকোনো ভালো ল্যাবরেটরিতে সহজেই করানো যায়। প্রায় সব রোগীর পেটের আলট্রাসনোগ্রাম ও কোনো কোনো রোগীর লিভার বায়োপসিও লাগে। লিভারের প্রদাহ শুরু হলে বা রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। যারা নেগেটিভ, তাদের টিকা দিতে হবে। যারা পজিটিভ, তাদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।
রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সহজলভ্য করতে পারলে সাধারণ লোকজন এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত হবে।