Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সার্কের হাল ধরতে হবে বাংলাদেশকেই

মু. মেছবাহ উদ্দিন খান | প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০২২, ১২:০৫ এএম

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৫ সালে সার্ক সম্মেলন শুরু হলেও এর বীজ বপন হয়েছিল আরও আগে। বাংলাদেশ এ রাষ্ট্রসংস্থার স্বপ্নদ্রোষ্টা। ১৯৭৭ সাল থকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উদ্যোগে নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনার ফল হিসেবে ১৯৮০ সালে দক্ষিণ এশীয় সাতটি দেশের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজন উল্লেখ করে একটি শীর্ষ স্মমেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাব একটি যুক্ত ঘোষণা আকারে গৃহীত হওয়ার আগে ১৯৮১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সাতটি দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের পাঁচটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয় কলম্বো, কাঠমান্ডু, ইসলামাবাদ, ঢাকা ও দিল্লিতে। পররাষ্ট্র সচিবদের দিল্লি বৈঠকে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব যুক্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়। সার্কের সদর দপ্তর নির্ধারণ করা হয় নেপালের কাঠমুন্ডু। এরপর বিষয়টি আসে রাজনৈতিক পর্যায়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দিল্লি, মালে, থিম্পু এবং ঢাকায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকগুলোতে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও চূড়ান্ত করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়ার আগেই অবশ্য সাতটি দেশ (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা) দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার ১১টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে: ১। টেলিযোগাযোগ; ২। আবহাওয়া; ৩। পরিবহন; ৪। জাহাজ; ৫। পর্যটন; ৬। কৃষি ও গ্রামীণখাত; ৭। যৌথ উদ্যোগ; ৮। বাজার সম্প্রসারণ: নির্বাচিত পণ্যসমূহ; ৯। বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহযোগিতা; ১০। শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা; ১১। সাংস্কৃতিক সহযোগিতা।

১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে নয়াদিল্লিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও একটি সমন্বিত কার্যব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য ফোরাম গঠনের কার্যকারিতা সম্বন্ধে এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ একমত হন। উদ্দেশ্য ও নীতিমালাগুলো হচ্ছে: ১। দক্ষিণ এশীয় জনগণের কল্যাণ ও মান উন্নয়ন করা। ২। এ সকল অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে ত্বরাম্বিত করা। ৩। প্রতিটি নাগরিককে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার সুযোগ দেয়া ও তার সম্ভাবনাকে পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করা। ৪। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যৌথ স্বনির্ভরতাকে উন্নত ও জোরদার করা। ৫। একে অন্যের সমস্যায় পারস্পারিক আস্থা, সমঝোতা ও সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা। ৬। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ও পাস্পারিক সহযোগিতায় উন্নয়ন ঘটানো। ৭। অভিন্ন স্বার্থের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা এবং অনুরূপ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে সহযোগিতা করা। ৮। সার্বভৌম সমতা, আঞ্চলিক অখন্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা। ৯। এসব সহযোগিতায় দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সহযোগিতার বিকল্প হবে না বরং উভয়েরই সম্পূরকরূপে গণ্য হবে, ১০। এ ধরনের সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক ও বহুমুখী বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সঙ্গতিহীন হবে না। এই সকল উদ্দেশ্য ও নীতিমালাকে সামনে রেখে পারস্পারিক সহযোগিতা, বিশ্বাস ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে প্রথম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় ১৯৮৫ সালের ৭ ডিসেম্বর। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশগুলো হলো: পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে ৮ম সদস্য দেশ হিসেবে যোগ হয় আফগানিস্তান। ঢাকায় প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর পারস্পারিক সহযোগিতার এই মনোভাব নিয়ে একের পর এক সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় সম্মেলন ভারতের ব্যাঙ্গালোরে ১৯৮৬ সালের ১৬ ও ১৭ নভেম্বর। তৃতীয় সম্মেলন নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৯৮৭ সালের ২ ও ৪ নভেম্বর। চতুর্থ সম্মেলন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১৯৮৮ সালের ২৯-৩১ ডিসেম্বর। পঞ্চম সম্মেলন মালদ্বীপের মালেতে ১৯৯০ সালের ২১-২৩ নভেম্বর। ষষ্ঠ সম্মেলন শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর। সপ্তম সম্মেলন বাংলাদেশের ঢাকায় ১৯৯৩ সালের ১০-১১ এপ্রিল। অষ্টম সম্মেলন ভারতের নয়া দিল্লিতে ১৯৯৫ সালের ২-৪ মে। নবম সম্মেলন মালদ্বীপের মালে ১৯৯৭ সালের ১২-১৪ মে। দশম সম্মেলন শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ১৯৯৮ সালের ২৯-৩১ জুলাই। একাদশ সম্মেলন নেপালের কাঠমুন্ডুতে ২০০২ সালের ৪-৬ জানুয়ারি। দ্বাদশ সম্মেলন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ২০০৪ সালের ২-৬ জানুয়ারি। ত্রয়োদশ সম্মেলন বাংলাদেশের ঢাকাতে ২০০৫ সালের ১২-১৩ নভেম্বর। চতুর্দশ সম্মেলন ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০০৭ সালের ০৩-০৪ এপ্রিল। পঞ্চদশ সম্মেলন শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ২০০৮ সালের ১-৩ আগস্ট। ষোড়শ সম্মেলন ভুটানের থিম্পুতে ২০১০ সালের ২৮-২৯ এপ্রিল। সপ্তদশ সম্মেলন মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ২০১১ সালের ১০-১১ নভেম্বর। অষ্টাদশ সম্মেলন নেপালের কাঠমুন্ডুতে ২০১৪ সালের ২৬-২৭ নভেম্বর।

দেখতে দেখতে সার্কের বয়স ৩৬ বছর পার হয়ে গেল। এই ৩৬ বছরে ১৮টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চার্টার অনুযায়ী প্রতিবছর একবার ‘সামিট’ হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়ে উঠেনি। প্রায় সময়ই দেখা গেছে, আয়োজনের শেষ পর্যায়ে এসে সম্মেলন স্থগিত হয়ে গেছে। সার্কের চার্টার বা সনদ অনুযায়ী সার্কের কর্মসূচি গৃহীত হয়ে থাকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে। ১৯তম সম্মেলন ৯ ও ১০ নভেম্বর ২০১৬ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা স্থগিত হয়ে যায়। প্রথমে ভারত ও পরে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান না করার কথা জানিয়ে দেয়। সার্কের সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ভুটানও অসম্মতি প্রকাশ করে। সার্ক সনদ অনুযায়ী সদস্য যে কোনো একটি দেশ যোগদানে অসম্মত হলেই আপনা আপনি সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। সার্ক জোটের ভাবনা নিয়ে এখন যে আদৌ এগোনো সম্ভব নয়, ভারত সফররত নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়। ১৯তম সম্মেলন মূলত ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতের জেরেই হতে পারেনি এবং অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সার্কের পরিবর্তে ভারত এখন ‘বিমস্টেক’ বা ‘বিবিআইএন’ এর মতো বিকল্প জোটগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করলেও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সার্কের মৃত্যু পরোয়ানা লিখে দেওয়ার সময় আসেনি, আর সেটা উচিতও হবে না।

সার্কের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রধানত ভারতের মনোভাবের জন্যই সার্ক গতিশীল হতে পারছে না। ভারতের কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বারবার স্থগিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ হচ্ছে সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলাদেশে সার্ক জন্মলাভ করেছে। সার্কের উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে তাই হতাশ হলে চলবে না। ১৯৮৫ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্বোধনী শীর্ষ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়বর্ধনে বলেছিলেন, ‘সার্ক একটি তরীর মতো। বিভিন্ন কারণে এ নৌযান ঝড়ের মধ্যে পড়ে আবতির্ত হবে। কিন্তু তরীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’ প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সার্ককে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের জনগণের উন্নয়নে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশকেই হাল ধরতে হবে।


লেখক: শিক্ষার্থী, মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম (মাস্টার্স), প্রেস ইন্সটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)



 

Show all comments
  • সাহিদুর রহমান ২৭ জুলাই, ২০২২, ১০:৫৩ এএম says : 0
    অনেক তথ্য জানলাম। ধন্যবাদ, মিসবাহ উদ্দিন ভাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সার্কের হাল ধরতে হবে বাংলাদেশকেই
আরও পড়ুন