পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অতিথি আপ্যায়নে যে জিনিসটি সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে তাকেই আমরা চা নামে জানি। চা-কে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উপভোগ্য করে তোলা হয়েছে। এ অতি পরিচিত পানীয়র পিছনে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে প্রতারণা, লাঞ্ছনা ও ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চনা।
আজ থেকে দু’শত বছর পূর্বে ব্রিটিশ অধিকৃত উপমহাদেশে চায়ের গোড়াপত্তন করা হয়। আজকালকার মতো চা বাগানগুলোতে তখন তেমন হাহাকার পরিলক্ষিত হতো না, প্রতি বছর অনুষ্ঠানাদির প্রাক্কালে বোনাস নিয়ে নেতা-মন্ত্রী ও ইউনিয়নকর্মীদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপও ছিল না। প্রতিটি বিষয় শ্রমিক প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের মধ্যে মালিক পক্ষের যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় সমাধান হতো। বর্তমানে এই প্রেক্ষাপট স¤পূর্ণ পাল্টে গেছে। দীর্ঘ দিনের প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বেশিরভাগ চা বাগানে কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।
বর্তমানে চা বাগানগুলোতে আন্তরিকতা ও ভালবাসার বন্ধন নেই বললেই চলে। খন্ডিত করে শাসন করো নীতিতে কিছু শ্রেণীবিভাগ পরিলক্ষিত হয়। সাহেব সম্প্রদায়, কর্মকর্তা সম্প্রদায় ও শ্রমিক সম্প্রদায়Ñ এ তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তরিকতার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয়। কেউ কারো প্রাধান্য সহ্য করতে পারেন না। যার জন্য চা বাগান পরিচালনব্যবস্থা এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। সর্বত্রই কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধে থাকতে দেখা যায়।
আজকাল যে কর্তা ব্যক্তিদের অধীনে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা কাজ করে থাকে তাদের মধ্যে অনেকেই এসেছে বিহার, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা, রাজস্থান ও গুজরাট থেকে। এ চায়ের সঙ্গে অনেকেরই নতুন পরিচিতি, তথাপি তাদের যোগ্যতা নেতা-মন্ত্রী, সেইল ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, লেবার অফিসার প্রভৃতির মদতপুষ্ট। সুতরাং চা স¤পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করে যেতে হয়। বাগান ডুবে যাবে কি ভেসে থাকবে তাতে কারও কিছু যায় আসে না। এ সকল কর্তা ব্যক্তির চা স¤পর্কে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রমিকের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেকে দক্ষ শাসক বলে প্রতিপন্ন করতে চায়। নিজেদের আনাড়িপনা ঢাকতে তারা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রমিককে পাত্তা দিতে চান না। তাই নিজেদের সে^চ্ছাচারিতাকে কাজে লাগায়, যার ফলস^রূপ অধিকাংশ বাগানই উৎপাদিত ফসলের টার্গেট পূর্ণ করতে পারে না এবং এতে উন্নতমানের চা তৈরিও ব্যাহত হয়। এদিকে চা বাগানগুলোর নাজুক অবস্থার জন্য দায়ী একটি যে মারাত্মক সমস্যা, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। আমরা প্রায়শই এ খবর পেয়ে থাকি যে, প্রতিবেশী দেশ হতে অতি নিম্নমানের চা চোরাই পথে আমাদের দেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। ঐ দেশের নিম্নমানের চা-এর সঙ্গে আমাদের দেশের চা একত্র করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এতে দেশের চা বাগানের মালিকেরা চা-এর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। আবার বিভিন্ন কারণে উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চা বাগানগুলোকে টিকিয়ে রাখাও কষ্টকর হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জরুরি ভিত্তিতে সামাধান না করলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের অধিকাংশ বাগানই গুণগত মানের চা তৈরি করতে ব্যর্থ, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, মালিক পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে অধিক ফলন দেখিয়ে চা-এর মানকে ব্যাহত করেন ও কোয়ালিটি প্রডাক্ট পায় না। চা বাগানগুলোতে ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরে বাবু ও শ্রমিকদের নায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এমন অভিযোগও শোনা যায়। তারা এমনি মনোভাব পোষণ করে যেন চা বাগানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের। তাই অধিকাংশ বাগানে ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের দৈনিক ৮/১০ ঘণ্টা কাজ করে যেতে চাপ সৃষ্টি করে। ছুটির দিনেও কাজ করে অনেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পায় না। অথচ উপর মহলের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা, বাংলো, চাকর-নকর, গাড়ি দৌড়ানো ও মোটা অঙ্কের বোনাস ইত্যাদি পেয়ে থাকে। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলো চা বাগানকে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে মনে করে। তাই সময় সময় ভুয়া প্রতিশ্রুতি ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে ক্ষেপিয়ে তোলে, যার কোনও সুষ্ঠু সমাধান কেউ খোঁজে পায় না। এ অবস্থাতে অধিকাংশ বাগানই বন্ধ হয়ে যাবার পথে। চা বাগানগুলোর দুরবস্থার প্রভাব শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের উপরই বর্তায় না। তার আংশিক প্রভাব পড়ে দেশ জুড়ে, এমনকি শহরে ব্যবসায়ী মহলেও টানাপোড়েন চলতে থাকে।
আজকাল চা বাগানের দুরবস্থার জন্য অনেকেই দায়ী করে চায়ের নিম্নমুখী বাজারদরকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজকাল নিলামে চায়ের বাজার দর ৮০/৯০ টাকার উপর পাওয়া যায় না বলে জানা যায়। মূল্য মূল খরচের অনুপাতে কম। নিলামের চা-ই বাজারে খুচরো একশত টাকার উপরে বিক্রি হয়ে থাকে। আজকাল অতি নিম্নমানের চাও বাজারে একশত টাকার নিচে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জনসাধারণ বুঝতে পারে এ চা চক্রে বড় রকমের কারচুপি বর্তমান। আমাদের সরকারও চা বাগানের এ সমস্যা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে বলে মনে হয় না। নতুবা এ চাকে সুষ্ঠু বাজারজাত করতে পারলে বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যেতো না। এমনিতেই দেশে সুষ্ঠু কর্মসংস্থান নেই, তদুপরি যদি চা বাগানগুলো বন্ধ হয়ে লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হয়ে যায় তবে নেতা-মন্ত্রীরা কি পারবেন তাদের পুনর্বাসন করতে বা সামাল দিতে? তাই সময় থাকতে সবাইকে এক জোট হয়ে কাজ করে যেতে হবে। একে অন্যের উপর দোষারোপ করে একটা অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি না করে প্রত্যেকেরই উচিত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আজকাল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা ও দালাল চক্রের হস্তক্ষেপে। অবশ্য এসবের পাশাপাশি দুর্নীতি নামক ব্যাধি তো আছেই। এদিকে দেখা যায়, বিভিন্ন চা বাগানে শেড ট্রি চোরাইপথে বিক্রী হচ্ছে। এর বিপরীতে নতুন শেড ট্রিও লাগানো হচ্ছে না। এতে চা বাগানগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ভাবতে বিস্ময় লাগে, আজকাল চা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা দীর্ঘ ৪০/৪২ বছর চা বাগানে চাকরি করে অবসর গ্রহণের পর সময় মতো তাদের পিএফ ও গ্র্যাচুয়িটি পায় না। অবসরের পরও সকাল-সন্ধ্যা কর্তৃপক্ষের কাছে করজোড়ে হাত পেতে থাকতে হয়। এমনিতেই বাগান কর্মচারীদের পেনশনের কোনও ব্যবস্থা নেই, তদুপরি যদি প্রাপ্য টাকা সময় মত না পাওয়া যায় তবে অসহায় বাগানকর্মীদের অবস্থা অনুমেয়।
চা বাগানগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। একদিকে চা-এর নিম্নমানের বাজার দর। তার উপর নানা রকমের ট্যাক্সের বোঝা, রাজনৈতিক দল ও নানা ইউনিয়নের সব পাইয়ে দেবার বাঘা বাঘা প্রতিশ্রুতি চা বাগানের শ্রমিককূলকে এক দ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে। তাই তাদের স^তঃপ্রবৃত্ত হয়ে কাজ করার বাসনা নেই বললেই চলে, যার ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়ে থাকে। অধিকাংশ বাগানের শ্রমিকরা ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আউট ডোরের কাজে যোগ দেয় এবং বেলা দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে কর্মস্থল ত্যাগ করে, যার ফলে অধিকাংশ বাগানের ‘লেবার আউট পুট’ নেই বললেই চলে অথচ কর্তৃপক্ষকে ন্যায্য মজুরি দিতে হয়। তাই ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত শ্রমিকদের লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, তারা যেন নিষ্ঠা সহকারে ৮ ঘণ্টা কাজ করে চা বাগানগুলোকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সোনার হাঁসের ডিম পেতে হলে হাঁসকে যত্নআত্তি করতে হবে। হাঁসকে মেরে ফেললে নিজেদেরই সমূহ ক্ষতি। মালিকপক্ষ কর্মচারীবৃন্দের সম্নিলিত প্রচেষ্টাই বাগানগুলো টিকে থাকার প্রধান শর্ত। তাই প্রয়োজন নিষ্ঠা সহকারে কাজ করে যাওয়া। সেই সঙ্গে ত্যাগ করতে হবে ফাঁকি দেবার মনোভাব। তা না হলে ক্ষতি নিজেদেরই। কাজে ফাঁকি দেবার প্রবণতাই চা বাগানগুলোকে দাঁড় করিয়েছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আজ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার বিকল্প নেই।
আজ অবশ্য দক্ষিণাঞ্চলের নদী ভাংগনের শিকার হয়ে স্থানীয় লোকদেরও চা-বাগানের কাজে জড়িত হতে দেখা যায়, যদিও চা স¤পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আস্তে আস্তে তারা চা শিল্পের সাথে নিজেদের জড়িত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে তাই জাত শ্রমিক ছাড়াও স্থানীয় এবং বরিশাল অঞ্চলের লোকদের কাজ করতে দেখা যায়। এটা ভালো লক্ষণ সন্দেহ নেই। চা শিল্প সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। এ শিল্পে জড়িত আছে হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে এই রুগ্ন শিল্প পুনর্জীবন পেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।