Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দশ বছরে কেপিএমের লোকসান ৩শ’কোটি টাকা

নুরুল আবছার চৌধুরী, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রশাসনিক অদূরদর্শিতা পরিকল্পনাহীনতা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও মাথাভারি প্রশাসনের কারণে দেশের বৃহত্তম কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী কাগজ কল (কেপিএম) নানা সমস্যায় জর্জরিত। কর্ণফুলী কাগজ কল বিগত দশ বছরে প্রায় ৩শ কোটি লোকসান গুনছে। চলতি অর্থবছর বার্ষিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক অর্জন সম্ভব হয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে কেপিএম যে কোন সময় চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মেহনতি শ্রমিক-কর্মচারীরা মনে করছেন। শ্রমিকরা জানান, মিলের উৎপাদনের সহায়ক বিভিন্ন কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। প্রতি বছরে গড়ে ৭০/৮০ লাখ টাকা লোকসানে পতিত হচ্ছে। কর্ণফুলী কাগজ কলে প্রতিবছর ৩৭ লাখ মেট্রিক টন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। চলতি অর্থবছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কাঁচামাল সংকট রয়েছে। প্রতিদিন ১শ’ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও কাঁচামাল সংকটের কারণে গড়ে ১০-৩০ মেট্রিক টন উৎপাদিত হচ্ছে। কর্ণফুলী কাগজ কলে কাঁচামাল বাঁশ, নরম কাঠ (পাল্পউড) প্রাপ্তি উৎসস্থল কাপ্তাইয়ের রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, চিড়িংগা, ঠা-াছড়ি, মানিকছড়ি, কাউখালী, কুতুবছড়ি, রাজস্থলী, কাপ্তাই বাঁধের উপর কাচালং, রাইক্ষ্যং, বাঘাইছড়ি, বরকল, নানিয়াচর, মারিশ্যা, লক্ষীছড়ি, বাঘাইহাটসহ পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদী ও সড়ক পথে কারখানায় সরবরাহ করে থাকে। আর্থিক সংকটের কারণে অধিকাংশ এলাকা থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে ঠিকাদারেরা জানান। মিল কর্তৃপক্ষ কাঁচামাল সরবরাহের জন্য একাধিকবার টেন্ডার আহ্বান করলেও ঠিকাদারেরা অংশগ্রহণে সাড়া দিচ্ছে না। এতে কাঁচামালের সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করা সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। মিলের সংকটময় মুহূর্তে কারখানা সচল রাখতে কর্তৃপক্ষ বিসিআইসি’র নিকট ২শ’ কোটি টাকা প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছে বলে মিল সূত্রে জানা গেছে। এই টাকা পাওয়া গেলে মিল আবারো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে জানান মিলের মহা ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আনোয়ার হোসেন। তবে মিলের পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করতে আরো বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। সূত্র জানায়, কর্ণফুলী কাগজ উৎপাদনের মন্ড তৈরিতে মূলত বাঁশ ও নরম কাঠ (পাল্পউড) ব্যবহার হয়। এছাড়াও বিদেশী পাল্প দিয়েও কাগজ উৎপাদন সম্ভব, তবে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত কাগজ টেকসই ও মজবুত। কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ মিল কর্তৃপক্ষের নিকট প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানা গেছে। গত তিন মাসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিল কর্তৃপক্ষ গড়ে দুই শতাংশ করে বিল পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে। যা মূল বিলের চেয়ে খুবই নগন্য। তা দিয়ে ঠিকাদারেরা শ্রমিকদেরকে নতুন করে কাজে নিয়োগ করতে পারছে না। আর্থিক সংকটের কারণে মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা ২ মাস বেতন পায়নি এবং ৫ মাসের ওভার টাইম বকেয়া রয়েছে। এই অবস্থায় মেহনতি শ্রমিক কর্মচারী ও অস্থায়ী শ্রমিকরা বেতনভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। কাগজ উৎপাদনে অন্যান্য কাঁচামাল লবণ, চুন, ট্যালকম পাউডার, সোডা, কস্টিক, এলাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মিলের নিকট প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সব মিলিয়ে মিলটি কোটি কোটি টাকা দেনার ভারে ভারাক্রান্ত। অথচ মিল এলাকায় ৫ হাজার পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করে মিলের গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ অপচয় করছে। সম্প্রতি ৪০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলেও সিংহভাগ অবৈধ বসতি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি হিসাব মতে, মিল এলাকায় বসবাসকারীরা মিল থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করে মিলকে লোকসানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অপচয় রোধ করা গেলে মিল আর্থিকভাবে লাভবান হবে। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খান জাভেদ আনোয়ার মিলে চলতি অর্থবছরে শুরুতে যোগদান করার পর কয়েকদিনের মধ্যে দৈনিক ৭০/৭৫ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করেন। গাফেলতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে একমাসের মাথায় কাঁচামাল সংকটের কারণে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। তা বর্তমানে নামমাত্র উৎপাদনে মিলটি চালু রয়েছে। কাঁচামাল সরবরাহকারীদের পাওনা যথাসময়ে মিল কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের মধ্যে চরম আর্থিক সংকট ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। মিলের কূপ এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও মিল থেকে যথাসময়ে বিল অর্থছাড় না হওয়ায় অধিকাংশ ঠিকাদার পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে ব্যবসার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে ঠিকাদারদের মূলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কর্ণফুলী কাগজ কল উৎপাদনের স্বার্থে ঠিকাদারেরা ধারকর্জ করে মিলে কাঁচামাল সরবরাহ দিয়ে আসছে। তাই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পাওনাদি ফেরত পেতে মিল কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারদের সময়মত বিল পরিশোধ না করায় চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছে। ঠিকাদারেরা জানান, পার্বত্য এলাকায় প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ বাঁশ, কাঠ কর্তন আহরণ এবং সরবরাহের মাধ্যমে কর্ণফুলী কাগজ কলের সাথে জড়িত রয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো চরম অর্থ সংকটের কারণে মিলে বাঁশ ও কাঠ সরবরাহ করতে চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছে। যথাসময়ে ঠিকাদারেরা টাকা দিতে না পারায় শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। গত একবছর যাবত পাহাড়ে কেপিএমের কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মরত শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পাহাড়ে শ্রমিকদের মাঝে অশান্তি ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেপিএমের সিবিএ সভাপতি তৌহিদ আল মাহবুব চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার স্মারক ৬ দফা আন্দোলনের সাথে কেপিএম প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িত। সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে মিলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারখানাটি প্রতিবছর সরকারকে ৫শ’ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে থাকে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে কাগজ কলকে রক্ষা করতে সরকারের নিকট মেহনতি শ্রমিকরা জোর দাবি জানান। বর্তমানে মিলের ২ হাজার ৩৭৬ জন দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। তার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক রয়েছে মাত্র ৫৪৫ জন। অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে ৫শ’ জন। কোম্পানি মাস্টাররোল ১২০জন। তাদের মাসিক বেতন সর্ব্বোচ্চ ৮৫-৯০ লাখ টাকা। অথচ ১২২ জন কর্মকর্তা ও ৩শ’ কর্মচারীর বেতন প্রায় ২ কোটি টাকা। যাদের শ্রমে ঘামে মিলের উৎপাদনের চাকা স্বাভাবিক রাখে সেই মেহনতি শ্রমিকদের চেয়ে তিনগুণ বেশি বেতন দিতে হয় মাথাভারি প্রশাসনকে। ২০১২-২০১৬ অর্থবছরে অবসরে যাওয়া ২শ’ শ্রমিক প্রায় ১৫ কোটি টাকা মিলের নিকট পাওনা রয়েছে। তাদের পাওনা টাকা পাওয়ার দাবিতে গত তিন মাস ধরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পাওনা ছাড়া কয়েকজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সব মিলিয়ে কেপিএম পুরানো যন্ত্রপাতি ও জরাজীর্ণ মেশিন দিয়ে কোন মতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং কাগজ শিল্পকে ধরে রাখার জন্য মিলকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার আন্তরিক হতে হবে। এ ব্যাপারে একাধিকবার অফিসে যোগাযোগ করা হলে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খান জাভেদ আনোয়ার অফিসের কাজে ব্যস্ততার কথা বলে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ