পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের দেশে সরকারি চাকরিজীবীরা সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে পড়ে। নিয়মিত বেতন ভাতা ও আবাসন সুবিধাসহ নানবিধ সুবিধা তারা পেয়ে থাকেন। একবার সরকারি চাকরি হলে নিরাপদ-নির্ঝাঞ্ঝাট জীবনযাপনের নিশ্চয়তা মিলে যায়। এজন্য সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের অনুরাগ-আগ্রহ অনেক বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি চাকরির জন্য মানুষের বেপরোয়া-ভাব ও আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি রীতিমত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঘুষ দেয়া ও নেয়া ছাড়া সরকারি চাকরি হয়, এমন কথা এখন কেউ বিশ্বাস করে না। সরকারি চাকরি পাওয়া মানে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। সরকারি চাকরির সুবাদে অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। ছোট-খাটো সরকারি কর্মচারীদেরও টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়ার কিচ্ছা-কাহিনী প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সম্প্রতি ময়মনসিংহ-সিভিল সার্জন অফিসের এক অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটরের বিপুল সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। গ্রামে-শহরে তার নাকি কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এধরনের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার খবর আর আমাদের বিস্ময় উদ্রেগ করে না। মাঝারি ও উচ্চ পদাধিকারী সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকের সম্পদ-সম্পত্তির পরিমাণ আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। ঘুষ, দুর্নীতি, কমিশনবাজি, সরকারি সম্পদ ও অর্থ লুটপাটের যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, তাতে দুর্নীতিবাজ ও অর্থলিপ্সু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশুমার অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া মোটেই অসম্ভব বা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশিদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা বিদেশে অর্থপাচার করে বাড়িঘর ও জমি-সম্পদ ক্রয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অভিযুক্তদের একাংশ যে সরকারি চাকরিজীবী, সেটাও এখন কারো অজানা নেই।
সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েছেন। তারা স্ত্রীর নামে, স্বামীর নামে, আত্মীয়-পরিজনের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। গত দেড় দশকে এভাবে ব্যবসা করে অনেক সরকারি চাকরিজীবীই বিপুল বিত্ত-সম্পদের মালিক হয়েছেন। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ডা. সাবরিনা চৌধুরীর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির চেয়ারম্যান হওয়ার কথা অনেকেরই স্মরণ আছে। তিনি সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে করোনা টেস্টের ভুয়া সাটিফিকেট দেয়ার মামলায় গ্রেফতার হন। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এমন অনেক সাবরিনাই রয়েছেন, যারা এখনো আলোচনায় আসেননি। আদালত সূত্রের বরাতে খবরে আরো দু’জনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এদের একজন হলেন মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) কর্মকর্তা পারভীন আক্তার। তিনি একটি ডেভলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান, তার স্বামী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অন্যজন হলেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন। সরকারি চাকরির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ব্যবসা করেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার স্ত্রী ছিলেন সরাসরি যুক্ত। খবরে এও জানানো হয়েছে, চাকরিজীবী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারা সাধারণত ফ্ল্যাট-প্লট-বাড়ি ক্রয়-বিক্রয়, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ রেন্ট-এ কার, পোল্ট্রি ফার্ম, মৎস্যখামার ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অথচ, সরকারি চাকরিজীবীদের কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া আইনে গর্হিত বা শর্ত সাপেক্ষ করা আছে। আইনবিধি বেতোয়াক্কা করেই তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গরজ দেখা যাচ্ছে না।
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ১৭ নম্বর বিধি অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না, অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না। বলা বাহুল্য, এ বিধিতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। অথচ, বিধি লংঘন করে সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই ব্যবসা করছেন বা বিভিন্ন কাজ করছেন, পরিবারের সদস্যদের দিয়েও ব্যবসা করাচ্ছেন। সরকারি কাজের পাশাপাশি কেউ অন্য কোনো কাজে জড়িত থাকলে সরকারি কাজ ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক। ‘চাকরিজীবী ব্যবসায়ীর’ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশংকা থাকে। সরকারের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাও থাকে। কাজেই, ব্যতিক্রম বাদে সরকারি চাকরিজীবীদের ব্যবসা করার বা ভিন্ন কোনো কাজ করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। অনুমোদন সাপেক্ষে কেউ এ সুযোগ নিতে চাইলে তার সম্পদের পূর্ণ হিসাব দাখিলসহ নিয়মিত শুল্ক-কর দেয়া বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। সেটা দেয়া হচ্ছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। যারা আইনবিধি অমান্য করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। দুদক এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়ে অবহিত করলেও তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এমন বেআইনি চর্চা বন্ধ হওয়া উচিত। আমরাও সেটা মনে করি। আমরা আশা করবো, অবিলম্বে এ বিষয়ে একটি তদন্ত, অনুষ্ঠিত হবে এবং বেআইনি ব্যবসাকারী চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর সরকারের অতিরেক নির্ভরশীলতা অপ্রয়োজনীয় হলেও এখন বাস্তব। এই নির্ভরশীলতা তাদের লাগামহীন, বেপরোয়া ও দুর্নীতিপ্রবণ করে তুলেছে। দলীয়করণ ও দলবাজি বন্ধ না হলে এটা বন্ধ হবে না। সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং নিয়োগ, বদলী, পদায়নের ক্ষেত্রে সচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।